অকালপ্রসবের হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে

সারাবিশ্বে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ প্রি-টার্ম বার্থ বা অকালপ্রসব। গর্ভধারণের ৩৭ সপ্তাহের আগেই ভূমিষ্ট হওয়ার ঘটনাকে বলা হয় প্রি-টার্ম বার্থ। অকালপ্রসূত বা প্রি-টার্ম জন্মের হার বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। ২০২০ সালে দেশে জন্ম নেওয়া শিশুর ১৬ দশমিক ২ শতাংশ প্রি-টার্ম বা নির্ধারিত সময়ের আগেই ভূমিষ্ট হয়েছে। জাতিসংঘ ও অংশীদার সংস্থাগুলো আজ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।

পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ প্রি-টার্ম বার্থ বা অকালপ্রসব

‘বর্ন টু সুন: ডিকেড অব অ্যাকশন অন প্রি-টার্ম বার্থ’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)। সংস্থা দুটির অংশীদার হিসেবে ছিল প্রসূতি, শিশু ও কিশোর বয়সীদের স্বাস্থ্য নিয়ে কর্মরত সংস্থাগুলোর সর্ববৃহৎ জোট পার্টনারশিপ ফর ম্যাটারনাল, নিউবর্ন অ্যান্ড চাইল্ড হেলথ (পিএমএনসিএইচ)। বিশ্বের ৪৬টি দেশের ১৪০ জন বিশেষজ্ঞ এ প্রতিবেদনের জন্য কাজ করেছেন।

প্রতিবেদনের তথ্য মতে, নবজাতক ও শিশুর স্বাস্থ্য ও বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে বিশ্বজুড়ে কয়েক দশক ধরে চলতে থাকা প্রয়াসের পিঠে ছুরিকাঘাত করতে চলেছে প্রি-টার্ম জন্মের হার বৃদ্ধি, যা এক নিরব সংকটকাল বা সাইলেন্ট ইমার্জেন্সি হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে।

প্রি-টার্ম বা নির্ধারিত সময়ের আগেই শিশুজন্মের হার ক্রমশ বাড়ছে। ২০১০ সালে সারাবিশ্বে জন্মগ্রহণকারী শিশুর ৯ দশমিক ৮ শতাংশ ছিল প্রি-টার্ম। ২০২০ সালে অকালপ্রসবের হার বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ।

২০২০ সালে বিশ্বে আনুমানিক ১ কোটি ৩৪ লাখ প্রি-টার্ম শিশুর জন্ম হয়, যার মধ্যে প্রায় ১০ লাখ নবজাতক অকালপ্রসবজনিত বিভিন্ন জটিলতায় মারা যায়। এর অর্থ হলো, গর্ভধারণের ৩৭ সপ্তাহ পূরণের আগেই জন্ম নেওয়া প্রতি ১০ শিশুর মধ্যে ১ জন প্রি-টার্ম বা অকালপ্রসবজনিত জটিলতায় মারা গেছে।

২০২০ সালে প্রি-টার্ম জন্মহারে শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ। সে বছর দেশে জন্মগ্রহণকারী শিশুর ১৬ দশমিক ২ শতাংশই ছিল অকালপ্রসূত। বাংলাদেশের পর দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল আফ্রিকার দেশ মালাওয়ি। সেখানে ২০২০ সালে জন্মগ্রহণকারী শিশুর ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল প্রি-টার্ম। পাকিস্তানে প্রি-টার্ম জন্মহার ছিল ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ।

উচ্চ আয়ের দেশগুলোতেও প্রি-টার্ম জন্মের প্রবণতা বাড়ছে। ২০২০ সালে গ্রিসে জন্মগ্রহণকারী নবজাতকের ১১ দশমিক ৬ শতাংশ ছিল অকালপ্রসূত। যুক্তরাষ্ট্রে সে বছর অকালপ্রসূত শিশুর হার ছিল ১০ শতাংশ, অর্থাৎ প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজন নির্ধারিত সময়ের আগেই ভূমিষ্ট।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সারাবিশ্বে ২০২০ সালে অকালপ্রসূত মোট শিশুর প্রায় অর্ধেকের (৪৫ শতাংশ) জন্ম হয়েছে পাঁচটি দেশে। এর মধ্যে রয়েছে- ভারত, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া, চীন ও ইথিওপিয়া।

বর্ন টু সুন: ডিকেড অব অ্যাকশন অন প্রি-টার্ম বার্থ প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত এক দশকে বিশ্বের কোনো অঞ্চলেই অকালপ্রসবের ঘটনা কমানোর ক্ষেত্রে তেমন উন্নতি হয়নি। বিশেষত চারটি সি- কনফ্লিক্ট (সংঘাত), ক্লাইমেট চেঞ্জ (জলবায়ু রূপান্তর), কোভিড-১৯ অতিমারি ও কস্ট অব লিভিং ক্রাইসিস (জীবনযাত্রার ব্যয়জনিত সংকট) ঝুঁকিগ্রস্ত মায়েদের ও শিশুদের জীবনের প্রতি হুমকি বাড়াচ্ছে।

প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে প্রি-টার্ম জন্মের হার বাড়ছে। যেমন ধরা যাক, বায়ু দুষণ। কেবল বায়ু দুষণজনিত কারণে প্রতি বছর বিশ্বে ৬০ লাখ অকালপ্রসবের ঘটনা ঘটছে। প্রসূতির স্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি, স্টিলবার্থ বা জড়জন্মের হার ও অকালপ্রসবের ঝুঁকি বাড়াছে জলবায়ু পরিবর্তন।

বিশ্বের যে দশটি দেশ মানবিক বিপর্যয়জনিত সংকটে ভূগছে, সেসব দেশে জন্ম নিচ্ছে প্রতি ১০ জন প্রি-টার্ম শিশুর একজন। বিশেষত নারী ও শিশুর যথাযথ স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ না থাকায় এ দশটি দেশে বছরে ১২ লাখ শিশু অকালপ্রসূত হচ্ছে।

পিএমএনসিএইচের নির্বাহী পরিচালক হেলগা ফগস্টাড বলেন, বিশ্বে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ প্রি-টার্ম বার্থ। এ ধরনের জন্মের প্রবণতা কমাতে বিনিয়োগ ও জবাবদিহি কেন জরুরি, বর্ন টু সুন প্রতিবেদনটি তা তুলে ধরছে। শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়নে ও স্টিলবার্থ ঠেকানোর ক্ষেত্রে যতটুকু উন্নতি হয়েছে, তা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে কোভিডজনিত অভিঘাত, সংঘাত, জলবায়ু রূপান্তর ও জীবনযাত্রার ব্যয়জনিত সংকটের কারণে।

সোমবার থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে শুরু হয়েছে নবজাতক ও প্রসূতি স্বাস্থ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন ইন্টারন্যাশনাল ম্যাটারনাল নিউবর্ন হেলথ কনফারেন্স (আইএমএনএইচসি)। এ উপলক্ষে ‘বর্ন টু সুন: ডিকেড অব অ্যাকশন অন প্রি-টার্ম বার্থ’ প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে ডব্লিউএইচও, ইউনিসেফ, ইউএনএফপিএ ও পিএমএনসিএইচ প্রসূতি ও নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন ও প্রি-টার্ম বার্থের ঝুঁকি কমানোর ওপর জোরারোপ করেছে।