নগদ অর্থ সংকটে ১৬ ব্যাংক

বছরের প্রথম প্রান্তিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ১৬টি ব্যাংকের তারল্যপ্রবাহ ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। এসব ব্যাংকে ঋণাত্মক তারল্য প্রবাহের মোট পরিমাণ ১৯ হাজার কোটি টাকা ছুঁতে চলেছে। স্বল্প সময়ে তেমন গুরুতর সমস্যা না হলেও দীর্ঘদিন ধরে তারল্য প্রবাহ ঋণাত্মক থাকলে ব্যাংকগুলো গুরুতর সমস্যায় পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

১৬ ব্যাংকে নগদ অর্থ সংকট

জানা গেছে, বছরের প্রথম তিন মাসের (জানুয়ারি-মার্চ) ব্যবসায় যে ব্যাংকগুলোর তারল্যপ্রবাহ ঋণাত্মক রূপ নিয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে ইসলামী ব্যাংক। একইভাবে, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এবি ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, এনআরবিসি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক ও উত্তরা ব্যাংকের তারল্য প্রবাহ ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ঋণাত্মক তারল্য প্রবাহ একটি ব্যাংকে নগদ অর্থের সংকটকে প্রতিফলিত করে। যে ব্যাংকে নগদ অর্থের সংকট বেশি তীব্র, সেখানে তারল্য প্রবাহ তত ঋণাত্মক। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সংকটগ্রস্ত ব্যাংকগুলো আন্তঃব্যাংক ঋণবাজার থেকে অর্থ নিয়ে তারল্য প্রবাহ সামাল দিতে সমর্থ হলেও সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে অথবা আন্তঃব্যাংক ঋণ না পেলে বিপদ হতে পারে।

তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, জানুয়ারি-মার্চ সময়কালে ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি পরিচালন তারল্য প্রবাহ বা অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো হয়েছে ঋণাত্মক ৫২ টাকা ৬ পয়সা। বিগত বছরে একই সময়ে ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো ছিল ২৪ টাকা ২২ পয়সা। শেয়ারপ্রতি অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো প্রায় ৭৬ টাকা নেমে যাওয়ায় ব্যাংকটির ঋণাত্মক তারল্য প্রবাহের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মোট ৮ হাজার ৩৮১ কোটি ৬১ লাখ ১৪ হাজার টাকা।

শরীয়াহ ধারার আরেক প্রতিষ্ঠান ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি তারল্য প্রবাহ হয়েছে ঋণাত্মক ৩০ টাকা ৯৪ পয়সা। ব্যাংকটির মোট ঋণাত্মক তারল্য প্রবাহ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২৩৬ কোটি ৩৪ লাখ ৯১ হাজার টাকা।

বেসরকারি খাতে প্রথম প্রজন্মের এবি ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি তারল্য প্রবাহ এখন ঋণাত্মক ১৮ টাকা ৪২ পয়সা। ব্যাংকটির মোট ঋণাত্মক তারল্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৮৫ কোটি ৮০ লাখ ৩২ হাজার টাকা।

ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক, এবি ব্যাংকের মুনাফাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর মধ্যে প্রথম দুটি ব্যাংকের মুনাফা কমলেও শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য বেড়েছে। এবি ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি মুনাফা ও সম্পদমূল্য দুটোই কমেছে।

শেয়ারপ্রতি ১০ টাকা ৭১ পয়সা ঋণাত্মক তারল্য নিয়ে সিটি ব্যাংকের মোট ঋণাত্মক তারল্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৮৫ কোটি ৮৪ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। বিগত বছরের মতো এবারও প্রথম প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি ৭৪ পয়সা মুনাফা করেছে ব্যাংকটি। শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্যও সামান্য বেড়েছে।

শেয়ারপ্রতি ১০ টাকা ৯৬ পয়সা ঋণাত্মক তারল্য নিয়ে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের মোট ঋণাত্মক তারল্যের পরিমাণ হয়েছে ১ হাজার ৩০ কোটি ৬৯ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। তবে মুনাফা ও সম্পদমূল্য দুটোই বেড়েছে ব্যাংকটির।

একইভাবে আইএফআইসি ব্যাংকের তারল্য প্রবাহ ঋণাত্মক হলেও শেয়ারপ্রতি মুনাফা ও সম্পদ বেড়েছে। শেয়ারপ্রতি ৩ টাকা ৫ পয়সাঋণাত্মক তারল্য প্রবাহ নিয়ে ব্যাংকটির মোট ঋণাত্মক তারল্য প্রবাহের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৪৪ কোটি ৭০ লাখ ২৮ হাজার টাকা।

তারল্য প্রবাহ ঋণাত্মক হলেও শেয়ারপ্রতি মুনাফা ও সম্পদমূল্য বেড়েছে যেসব ব্যাংকের, তার মধ্যে আছে মিডল্যান্ড ব্যাংক। শেয়ারপ্রতি ৮০ পয়সা ঋণাত্মক তারল্য নিয়ে ব্যাংকটির মোট ঋণাত্মক তারল্য প্রবাহের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫১ কোটি ১৭ লাখ ৩৫ হাজার টাকা।

বছরের প্রথম তিন মাসে তারল্য প্রবাহ, মুনাফা ও সম্পদমূল্য- সব ক্ষেত্রেই করুণ দশায় পড়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক। ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি তারল্য প্রবাহ ঋণাত্মক ২ টাকা ২৭ পয়সা। ব্যাংকের মোট ঋণাত্মক তারল্য প্রবাহের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৩০ কোটি ৮৮ লাখ ৮ হাজার টাকা। একই সময়ে ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি ৯৭ পয়সা লোকসান ও সম্পদমূল্য ৪ টাকা ১২ পয়সা কমেছে।

এছাড়া এনআরবিসি ব্যাংকে শেয়ারপ্রতি ১ টাকা ২৭ পয়সা করে মোট ১০০ কোটি ৭০ লাখ ৬৬ হাজার টাকা, প্রাইম ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি ১ টাকা ৩৫ পয়সা করে মোট ১৫২ কোটি ৮৫ লাখ ৮২ হাজার টাকা, পূবালী ব্যাংকে শেয়ারপ্রতি ৫ টাকা ৫৮ পয়সা করে মোট ৫৭৩ কোটি ৭৮ লাখ ৮১ হাজার টাকা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে শেয়ারপ্রতি ৫ টাকা ৮৩ পয়সা করে মোট ৬০২ কোটি ৯১ লাখ ১৯ হাজার টাকা ও উত্তরা ব্যাংকে শেয়ারপ্রতি ৪ টাকা ৬৭ পয়সা করে মোট ৩৪২ কোটি ৭১ লাখ ৩৮ হাজার টাকা ঋণাত্মক তারল্য প্রবাহ দাঁড়িয়েছে। তবে পাঁচটি ব্যাংকেরই শেয়ারপ্রতি মুনাফা ও সম্পদমূল্য বেড়েছে।

অন্যদিকে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ও ট্রাস্ট ব্যাংকে শেয়ারপ্রতি তারল্য প্রবাহ ঋণাত্মক হওয়ার পাশাপাশি মুনাফাও কমেছে। তিনটি ব্যাংকে মোট ঋণাত্মক তারল্য প্রবাহের পরিমাণ যথাক্রমে ৩৫ কোটি ৪৪ লাখ ২ হাজার টাকা, ২৯৯ কোটি ৫০ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও ১১৭ কোটি ৫৩ লাখ ৬৬ হাজার টাকা।

এ বিষয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, কোনো ব্যাংকের তারল্য প্রবাহ ঋণাত্মক হয়ে পড়লে হয়ত আন্তঃব্যাংক থেকে ধার নিয়ে চালিয়ে দিতে পারবে। তবে আন্তঃব্যাংক যদি ধার না দেয়, তখন ব্যাংক ডিফল্ট হয়ে যাবে। এটা হতে দেওয়া যাবে না।

তিনি বলেন, ১৬টি ব্যাংকে তারল্য সংকটের বিষয়টি ব্যাংকখাতের সমস্যার চেয়ে ওই ব্যাংকগুলোর বড় সমস্যা। অনেক ব্যাংক পর্যাপ্ত তারল্য না রেখেই লাভের আশায় ঋণ দিয়ে দিচ্ছে। এটা বাজে চর্চা। এমন করা উচিত নয়। পর্যাপ্ত তারল্য রাখতে হবে।