বাজেট হয় তবে শতভাগ বাস্তবায়ন হয় না

নীতি-নির্ধারকদের অতি-আশাবাদ আর সরকারি সংস্থাগুলোর অদক্ষতার কারণে জাতীয় বাজেটের শতভাগ বাস্তবায়ন হয় না বহু বছর ধরে। এতে করে অধরা থেকে যায় উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, অমিল রয়ে যায় বিভিন্ন খাত ও শ্রেণি-পেশার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাবে। বিগত বছরগুলোর বাজেট বাস্তবায়নের হিসাব পর্যালোচনায় এ চিত্র উঠে এসেছে।

বাজেট হয় তবে শতভাগ বাস্তবায়ন হয় না

চলতি অর্থবছরের সার্বিক ব্যয় পরিকল্পনা কাটছাঁট করে ৬ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে এনেছে সরকার। অর্থবছরের শুরুতে যে ৬ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় প্রস্তাব পাশ হয়েছিল, সংশোধিত পরিকল্পনা তার ৯৭ শতাংশে নেমেছে। চলতি অর্থবছর শেষ হচ্ছে ৩০ জুন। বাজেট বাস্তবায়নের বিদ্যমান হার অব্যাহত থাকলে এটা হবে টানা ১৪ বছরের মতো পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের অমিলের বছর।

বাজেট পরিকল্পনার সঙ্গে বাস্তবায়নের এ অমিলকে ‘দুষ্টচক্র’ অভিহিত করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, প্রতি বছর আমরা তহবিল বরাদ্দ করি কিন্তু পুরো তহবিল ব্যয় করতে পারি না। এতে করে বাজেটের পূর্ণ বাস্তবায়নের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দেখা যায়, ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে বাজেট বাস্তবায়নের গড় হার ৮৬ শতাংশ। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৯৭ ভাগ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়েছিল ২০১১ সালে। এবারের সংশোধিত ব্যয় পরিকল্পনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে আমরা ২০১১ সালের বাস্তবায়ন-হারকে ছুঁতে পারব।

২০০৭-০৮ ও ২০০৮-০৯ অর্থবছরের বাজেট উত্থাপনকারী ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, পরিকল্পিত বাজেট বাস্তবায়নে ব্যর্থতার মূল কারণ হলো সরকারি কর্মকর্তাদের অদক্ষতা ও জবাবদিহিতার অভাব। বাজেট বাস্তবায়নে সাফল্য ও ব্যর্থতার জন্য পুরষ্কার ও সাজা প্রবর্তনের পক্ষে তিনি মতপ্রকাশ করেন।

ইনস্টিটিউট অব ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরীর মতে, দেশে বাজটে প্রণয়নের প্রক্রিয়া অতি-রাজনৈতিক। বাস্তবায়ন সম্ভব নয় জানা সত্ত্বেও সব পক্ষকে খুশি রাখতে যে ব্যয় পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়, তাতে অতি-আশাবাদের ছাপ থেকে যায়। যারা বিভিন্ন প্রাক্কলন করেন তারা লক্ষ্য পূরণ হবে না জেনেও ক্রমশ আগের চেয়ে উঁচু লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে থাকেন।

তিনি বলেন, বাজেটের পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়ায় অগ্রাধিকারের জায়গাগুলো ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। সড়ক-মহাসড়কের মতো ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে অধিক অর্থ ব্যয় হচ্ছে, অন্যদিকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তার মতো অভৌত অবকাঠামোতে বরাদ্দ সেভাবে বাড়ছে না। আমরা এই গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে পিছিয়ে পড়ছি।

তিনি আরও বলেন, এক-দুই বছর বাজেট পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে মানা যায়। তবে বছরের পর বছর এটা চলতে দেওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে কোথাও সমস্যা আছে। সমস্যাগুলো খুঁজে বের করে সমাধান করা জরুরি।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যে দেখা যায়, ২০২০-২১ পর্যন্ত ১৩ অর্থবছরে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের গড় হার ৮১ শতাংশ। সরকারি কর্মচারীদের বেতন, ঋণের সুদ পরিশোধের মতো পরিচালন-ব্যয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এ হার ৮৮ শতাংশ।

এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, প্রয়োগহীনতার এক দুষ্টচক্রে বাঁধা পড়েছে বাজেট। এটা দুঃখজনক হলেও এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, উন্নয়ন খাতে ব্যয় পরিকল্পনা যথাযথ বাস্তবায়ন হলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতি পায়, বিনিয়োগ আসে, কর্মসংস্থান হয়, মানুষের আয় বাড়ে। আর্থিক পদক্ষেপগুলো প্রয়োগ হলে জীবনমান উন্নত হয়। কিন্তু এসবের প্রয়োগে ব্যর্থতার কারণ নিয়ে বিশ্লেষণ নেই, সংসদে বিষয়গুলো আলোচনা হয় না।