বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ভরাডুবির ১২ কারণ

এবারের বিশ্বকাপে ভরাডুবি হয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের। সাত ম্যাচের ছয়টিতেই হারতে হয়েছে। শিকার হতে হয়েছে নেদারল্যান্ডসেরও। সবচেয়ে হতাশার হচ্ছে, হেরে যাওয়া ম্যাচগুলোতে ন্যূনতম প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারেনি টাইগাররা। পয়েন্ট তালিকার দলের অবস্থান কার্যত নয় নম্বরে। সাকিব আল হাসানদের নিচে আছে কেবল বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড। যদিও সবার আগে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়ে গেছে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ যাত্রা। আসরে বাকি দুটি ম্যাচ দলের জন্য এখন শুধুই নিয়মরক্ষার। কেন এই বিপর্যয়? টোয়েন্টিফোর লাইভ নিউজপেপারের পর্যবেক্ষণে এই ভরাডুবির নেপথ্য কিছু কারণ বেরিয়ে এসেছে। দেখে নেওয়া যাক সেসব কারণ:

এবারের বিশ্বকাপে সবার আগে বিদায় নিশ্চিত হয়েছে বাংলাদেশ দলের

১. সাকিবের বাজে নেতৃত্ব: ভারত বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে প্রায় আড়াই বছর ধরে দল গুছিয়েছেন অধিনায়ক তামিম ইকবাল। কিন্তু টুর্নামেন্ট শুরুর আগে ঘটনা পরম্পরায় নেতৃত্ব ছাড়তে হয়েছে তাকে। এমনকি বিশ্বকাপ দলেও জায়গা হয়নি তার। তামিমের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশ দলে নেতৃত্বের ঘাটতি ফুটে উঠেছে। সাকিবের বাজে অধিনায়কত্বে হেরেই চলেছে টাইগাররা।

২. তামিমের অনুপস্থিতি: তামিমের অনুপস্থিতিতে কেবল নেতৃত্বের ঘাটতিই দেখা দেয়নি, বরং দুর্বল হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের টপ অর্ডার। আসরের শুরু থেকেই ব্যর্থ হয়েছেন উপরের সারির ব্যাটারা। বেশির ভাগ ম্যাচেই পাওয়ার-প্লেতে দুই-তিনটি করে উইকেট হারিয়ে ফেলেছে দল। এ কারণে সংগ্রহটাও বড় হয়নি। প্রায়সব ম্যাচেই চাপ নিয়ে খেলতে হয়েছে মিডল অর্ডার ব্যাটারদের।

৩. বিকল্প ওপেনার সংকট: এমনিতেই তামিমকে রাখা হয়নি দলে। তার শূন্যস্থানে রান করতে পারছেন না নবাগত তানজিদ তামিম। লিটন দাসও হতাশ করছেন বেশির ভাগ ম্যাচে। রান পাচ্ছেন না তিনে নামা নাজমুল হোসেন শান্ত। অথচ বিশ্বকাপের আগে কি ছন্দেই না ছিলেন তিনি। তাদের ব্যথর্তায় তামিমকে নিয়ে হাহাকার হচ্ছে। বাংলাদেশ এই বিশ্বকাপ খেলছে বিকল্প কোনো ওপেনার ছাড়াই!

৪. পেসারদের ব্যর্থতা: বাংলাদেশের পেস বিভাগ নিয়ে অনেক আশা ছিল। আশার পালে বাড়তি হাওয়া দিয়েছিল অ্যালান ডোনাল্ডের নেতৃত্বাধীন চমৎকার পেস বিভাগ। কিন্তু আসরের শুরুর থেকেই হতাশ করে আসছেন পেসাররা। তারা উইকেট পাচ্ছেন না নতুন বলে; স্লগ ওভারে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছেন না প্রতিপক্ষের রানের চাকা। মিডল ওভারগুলোতেও ভুগতে হচ্ছে মোস্তাফিজ-তাসকিন-শরিফুলদের। সবচেয়ে কার্যকর পেসার যিনি হয়ে উঠতে পারতেন সেই ইবাদত হোসেন আবার চোটের কারণে খেলতে পারছেন না এই বিশ্বকাপ। তার জায়গায় সুযোগ পাওয়া তানজিম সাকিবকে এখন পর্যন্ত খেলানোই হয়নি! প্রশ্ন উঠছে তাহলে কেন ৫ পেসার নিয়ে বিশ্বকাপ দল গঠন করা হলো।

৫. রিয়াদকে টপ অর্ডারে না রাখা: এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের সেরা পারফর্মার মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। অথচ প্রায়সব ম্যাচে নিচের দিকে ব্যাটিং করতে হয়েছে তাকে। রিয়াদকে বিবেচনা করা হচ্ছিল ফিনিশার হিসেবে। অথচ টপ অর্ডারের নিয়মিত ধস ঠেকাতে ফর্মে থাকা এই অলরাউন্ডারকে উপরের দিকে খেলানো উচিত ছিল। সেটি না হওয়ায় মিডল ও লোয়ার অর্ডারে চাপ নিয়ে ব্যাটিং করতে হয়েছে রিয়াদকে।

৬. আলগা ফিল্ডিং: আসরজুড়ে বাজে ফিল্ডিং করেছে বাংলাদেশ। আলগা ফিল্ডিংয়ের কারণে বাড়তি অনেক রানও দিতে হয়েছে টাইগারদের। অথচ এই বিশ্বকাপে কিছু ম্যাচের পার্থক্য গড়ে দিয়েছেন ফিল্ডাররা। বাংলাদেশ যে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে অঘটনের শিকার হলো সেটিও এই বাজে ফিল্ডিংয়ের কারণে। ডাচদের বিপক্ষে কেবল মোস্তাফিজুর রহমানের বলেই তিনটি ক্যাচ ছেড়েছেন ফিল্ডাররা।

৭. পরীক্ষা-নিরীক্ষা: এশিয়া কাপ ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষের সিরিজে দল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে টিম ম্যানেজমেন্ট। হাস্যকরভাবে বিশ্বকাপেও শেষ হয়নি দলের এক্সপেরিমেন্ট। আসরজুড়ে বিভিন্ন পজিশনে ব্যাটিং করতে হয়েছে মেহেদি হাসান মিরাজ ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে। এমনটি অধিনায়ক সাকিবও নিজের ব্যাটিং পজিশন বদল করেছেন। বারবার ব্যাটিং পজিশন অদল-বদল করার কারণে আদর্শ কোনো ব্যাটিং বিভাগ গড়ে তুলতে পারেনি বাংলাদেশ।

৮. প্রত্যাশার চাপ: বাংলাদেশকে ঘিরে অনেক প্রত্যাশা ছিল সমর্থকদের। কিন্তু সাকিবরা ভেঙে পড়েছেন প্রত্যাশার চাপে। বাড়তি চাপের কারণে টাইগাররা স্বাভাবিক পারফরম্যান্সটাই করতে পারেননি। অধিনায়ক সাকিব মেনে নিয়েছেন নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে বাজে বিশ্বকাপ পার করছে বাংলাদেশ।

৯. পাওয়ার হিটারের অভাব: বাংলাদেশ দলে তেমন কোনো পাওয়ার হিটার নেই। কেবল লিটন দাসকেই বিবেচনা করা হয় পাওয়ার হিটার হিসেবে। কিন্তু আসরে নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন তিনি। বেশির ভাগ ম্যাচে তিনি সাজঘরে ফিরে গেছেন শুরুর দিকে। তাই বাংলাদেশ দলের সংগ্রহও বড় হয়ে ওঠেনি।

১০. আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি: বিশ্বকাপ শুরুর আগেই বাংলাদেশ দলের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরেছিল। যেটি এখন গিয়ে ঠেকেছে তলানির দিকে। ক্রিকেটারদের শারীরী ভাষাতেও তা স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। এই বাংলাদেশ জিততে ভুলেই গেছে। লাগাতার পরাজয় দলের আত্মবিশ্বাস নিয়ে গেছে শূন্যে কোঠায়।

১১. দলীয় ভারসাম্যহীনতা: বিশ্বকাপের আগে থেকেই বাংলাদেশ দলে ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে। তামিম ইকবালকে বাদ দিতে গিয়েই এই সমস্যাটা প্রকট হয়ে ওঠেছে। বিশ্বকাপে বেশির ভাগ ম্যাচ খেলে ফেললেও এখনও বাংলাদেশ দলে আসেনি ভারসাম্য। ব্যাটিং ও বোলিং দুই বিভাগেই তাই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েই যাচ্ছে টিম ম্যানেজমেন্ট।

১২. পেস বোলিং অলরাউন্ডার না থাকা: বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে নেই কোনো পেস বোলিং অলরাউন্ডার। এমন একজন ক্রিকেটারের ভূমিকা কী তা প্রায়সবাই জানেন। ইংল্যান্ডের বেন স্টোকস, ভারতের হার্দিক পান্ডিয়া, নিউজিল্যান্ডের জিমি নিশামের মতো পেস বোলিং অলরাউন্ডারদেরকে অনেক ম্যাচের ভাগ নির্ধারণে দেখা গেছে। আর গত বিশ্বকাপে তো স্টোকস অতিমানবীয় পারফর্ম করে ইংল্যান্ডকে এনে দিয়েছেন স্বপ্নের ট্রফি।