ধনী-দরিদ্র মাপকাঠিতে পানির ৫ রকম দাম ধরছে ওয়াসা

বিগত ১৪ বছরে চৌদ্দবারই পানির দাম বাড়িয়েছে ঢাকা ওয়াসা। আরেকবার পানির দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে সংস্থাটি। তবে এবার আর্থিক সামর্থ্য ধরে ঢাকার বাসিন্দাদের ৫ মাপকাঠিতে ফেলে পানির ৫ রকম দাম নির্ধারণ করতে যাচ্ছে ওয়াসা। তাতে বর্তমান দামের তুলনায় শ্রেণিভেদে ন্যূনতম ২৪ শতাংশ থেকে ১৪৭ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হলে নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত সব গ্রাহকের পানিতে খরচ বাড়বে।

ফের পানির দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে ঢাকা ওয়াসা

বর্তমানে রাজধানীর আবাসিক গ্রাহকদের জন্য ঢাকা ওয়াসার পানির দাম প্রতি ইউনিটে অর্থাৎ ১ হাজার লিটারে ১৫ টাকা ১৮ পয়সা। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই এই একই হারে পানির বিল দিয়ে থাকেন। অন্যদিকে বাণিজ্যিক গ্রাহকদের দিতে হয় প্রতি হাজার লিটারে ৪২ টাকা।

ঢাকা ওয়াসার দাবি, বর্তমানে উৎপাদন খরচের তুলনায় কম দামেই পানি পাচ্ছে রাজধানীর বাসিন্দারা। প্রতি ইউনিট পানিতে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে ১০ টাকা। এই ভর্তুকি কমিয়ে লাভে থাকা ওয়াসার লাভ আরও বাড়াতে পানির দাম সমন্বয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে।

ঢাকা ওয়াসা গত কয়েক বছর ধরেই গ্রাহকের আর্থিক সামর্থ্য ধরে পানির দাম নির্ধারণের পরিকল্পনা করছিল। তবে বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে বর্তমান স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের একটি বক্তব্যে। ঢাকা ওয়াসা ভবনে গত রবিবার এক অনুষ্ঠানে মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেছেন, ঢাকার ধনীদের ভর্তুকি দিয়ে পানি সরবরাহ উচিত নয়।

এরপরই সরগরম হয়ে ওঠেছে ঢাকা ওয়াসা। সংস্থাটির মার্কেটিং ম্যানেজার উত্তম কুমার রায় বলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, পানির দাম সমন্বয় করতে চাই আমরা। দাম নির্ধারণে কয়েকটি ধাপ রয়েছে। গ্রাহকদের সুবিধা-অসুবিধা মাথায় রেখেই নতুন দাম নির্ধারণ হবে।

ঢাকার বাসিন্দাদের সামর্থ্য বিবেচনায় নিয়ে পানির দাম নির্ধারণে এরই মধ্যে এলাকাভিত্তিক পানির মূল্য নির্ধারণবিষয়ক কারিগরি সমীক্ষা সম্পন্ন করেছে ওয়াসা। সমীক্ষায় নিম্ন-আয়ের, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত- এই পাঁচ শ্রেণিতে গ্রাহকদের ভাগ করে পানির দাম নির্ধারণ করার প্রস্তাব হয়েছে।

প্রস্তাবে প্রতি ইউনিট পানির দাম নিম্ন-মধ্যবিত্তের জন্য ১৮ টাকা ৭৫ পয়সা, মধ্যবিত্তের জন্য ২৫ টাকা, উচ্চমধ্যবিত্তের জন্য ৩১ টাকা ২৫ পয়সা এবং উচ্চবিত্তদের জন্য ৩৭ টাকা ৫০ পয়সা প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া বাণিজ্যিক গ্রাহকদের জন্য ৪২ টাকার জায়গায় ৫০ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে।

জানা গেছে, ওয়াসা আর্থিক সামর্থ্যের শ্রেণিভাগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড-২০০০ বিবেচনায় নিয়েছে। তাতে যারা ২৫০০ বর্গফুটের বেশি আয়তনের বড় বাসায় থাকেন তারা উচ্চবিত্ত; ১৫০০ থেকে ২৫০০ বর্গফুটের বাসায় বসবাসকারীরা উচ্চমধ্যবিত্ত; ১০০০ থেকে ১৫০০ বর্গফুটের বাসায় থাকলে মধ্যবিত্ত এবং ১০০০ বর্গফুটের নিচের মানুষদের নিম্ন-মধ্যবিত্ত ধরা হয়েছে। আর বস্তির বাসিন্দাদের নিম্ন-আয়ের ধরা হয়েছে।

এদিকে ওয়াসার একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও কেন তাদের ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে, তার কোনো জবাব যেমন নেই, তেমনি ওয়াসার পানির উৎপাদন খরচই বা কত, সেটিরও কোনো নির্দিষ্ট তথ্য নেই।

যদিও ২০২২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ওয়াসা ভবনে এক অনুষ্ঠানে ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান বলেছিলেন, প্রতি ইউনিট (১ হাজার লিটার) পানির উৎপাদন খরচ গড়ে ২৫ টাকা। বিক্রি করা হচ্ছে ১৫ টাকায়।

তবে ওয়াসার একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পানির উৎপাদন খরচ বলে যে তথ্য ওয়াসার এমডি দিয়েছেন, সেটি বাস্তবসম্মত নয়। কেননা, ২৫ টাকা উৎপাদন খরচ হয় মূলত ভূ-উপরিভাগের উৎস থেকে পরিশোধিত পানির। কিন্তু বর্তমানে ওয়াসার সরবরাহ পানির ৭০ ভাগই গভীর নলকূপের মানে ভূগর্ভস্থ উৎসের, বাকি ৩০ শতাংশ কেবল ভূ-উপরিভাগের উৎসের। যেহেতু, গভীর নলকূপের পানির উৎপাদন খরচ অনেক কম, তাই পানিতে ১০ টাকা ভর্তুকির দাবি সঠিক নয়।

তাছাড়া নগরবিদদের দাবি, ঢাকা ওয়াসা দৈনিক যত পানি উৎপাদন করে, তার ২০ শতাংশই কাগজে-কলমে তারা ‘সিস্টেম লস’দেখায়। অথচ অভিযোগ রয়েছে, এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী পানির অবৈধ সংযোগ দিয়ে টাকা নেন। এই সিস্টেম লস কমানো গেলে পানির দাম বাড়াতে হতো না ওয়াসাকে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি নগরবিদ আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ধনী হোক বা গরিব হোক, কারো ওপরেই অযৌক্তিক ব্যয়ভার চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। ঢাকা ওয়াসার অস্বচ্ছতা দূর করলে পানির দাম বাড়ানো লাগতো না। ওয়াসা একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, পানির দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিষয়টি তাদের মাথায় রাখা উচিত।