ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা: সুদসহ ভাতা আদায় করবে সরকার, মামলারও হুঁশিয়ারি
- Details
- by আন্তর্জাতিক ডেস্ক
যারা প্রতারণা, জালিয়াতি ও ভুয়া তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ভোগ করে আসছেন, সরকার তাদের কাছ থেকে সুদসহ ভাতার টাকা আদায় করবে। পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লোগো
জানা গেছে, এ পর্যন্ত প্রায় ৮ হাজার লোক জালিয়াতির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধার সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন অথবা করছেন। সরকার তাদের কাছ থেকে সরকারি ভাতার টাকা আদায় করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করবে। এছাড়াও, এ বিষয়ে জনস্বার্থে দাবি আদায় আইনে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আগামী সপ্তাহ থেকে সকল জেলা প্রশাসক এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চিঠি পাবেন।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জানান, গত ১২ জুন সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক সভায় জালিয়াতি করে যারা মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ভোগ করেছে তাদের কাছ থেকে সুদসহ টাকা আদায়ের পরামর্শ, সুপারিশ এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও জানান, ‘আমরা ৮ হাজার জাল মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিল করেছি। আমরা জানি ভাতার টাকা আদায় করা কঠিন কাজ, তাই আমরা সবার জন্য ফাইল খুলব। সবাই বিভিন্ন সময়ে ভাতা পেয়েছেন এবং কে কত টাকা নিয়েছেন তা আমরা খুঁজে বের করব। তাদের কে সুপারিশ করেছে তাও আমরা তদন্ত করব। মামলা-মোকদ্দমা হতে পারে, কিন্তু আমরা অবশ্যই সরকারের টাকা আদায় করব।’
২০২০ সালের অক্টোবরে সকল বীর মুক্তিযোদ্ধার জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) এবং সরকার অনুমোদিত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যাচাই করে একটি ব্যবস্থাপনা তথ্য ব্যবস্থা (এমআইএস) ডাটাবেস চালু করে সরকার। ‘লাল মুক্তিবার্তা’, ‘ভারতীয় তালিকা’ এবং ‘গেজেট’ -এর ভিত্তিতে এই ডাটাবেজে নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য বিবেচনা করা হয়। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত তালিকায় প্রায় ২ লক্ষ ৫ হাজার নাম রয়েছে, তবে প্রথমে ১ লক্ষ ৭১ হাজার নাম এমআইএস ডাটাবেজে অন্যান্য তথ্যসহ যুক্ত করা হয়েছিল।
এদিকে, যেসব মুক্তিযোদ্ধার নাম এমআইএস ডাটাবেস এবং সম্মিলিত তালিকায় যুক্ত রয়েছে তাদের উত্তরাধিকারীদের ডিজিটাল সনদ বিতরণের ব্যবস্থা করেছে মন্ত্রণালয়। ডিজিটাল সনদ বিতরণের জন্য ১৩ নির্দেশনা রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের। এর মধ্যে একটি নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো মুক্তিযোদ্ধার গেজেট বা সনদ ইতিপূর্বে বাতিল করা হয়ে থাকে, তাহলে তাদের ডিজিটাল সনদ ও স্মার্ট আইডি কার্ড বিতরণ স্থগিত থাকবে।’
পূর্বে, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের দুই নেতা - এনামুল হক বিশ্বাস এবং মোহাম্মদ আলী কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার মৃত মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমানের স্ত্রী সালেহা খাতুনের নামে তার মৃত্যুর পর একটি জাল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে প্রায় ৮ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছিলেন। অবশ্য তদন্তের পর তারা টাকা ফেরত দেন।
সিরাজগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ হোসেন তাদের মধ্যে একজন যিনি অনিয়মের মাধ্যমে ভাতা পাওয়ার পর তা ফেরত দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে দেওয়া এক চিঠিতে, তিনি দুটি উপজেলা (কাজীপুর ও ধুনট) থেকে ভাতা পাওয়ার কথা স্বীকার করেন এবং ধুনট থেকে ভাতা বাতিল করে তা ফেরত দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন।
আইনি ব্যবস্থার নজির নেই
অতীতে বিভিন্ন সময়ে জালিয়াতির তথ্য পাওয়া গেলেও কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে কিছু ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছিল, কিন্তু মামলা বা আইনি ব্যবস্থা কোনটাই নেওয়া হয়নি।
২০১৪ সালে পাঁচজন সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জাল মুক্তিযোদ্ধার সনদ নেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হয়। ঐ বছরের ২২ সেপ্টেম্বর এক গেজেট প্রকাশ করে তৎকালীন স্বাস্থ্যসচিব এম নিয়াজ উদ্দিন মিয়া, তৎকালীন লোক সেবা কমিশনের সচিব এ কে এম আমির হোসেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী এবং একই মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবুল কাশেম তালুকদারের মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিল করা হয়। রাষ্ট্রমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তখন প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা সাবেক সচিব মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানের মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিল করা হয়। জাল সনদ প্রমাণিত হওয়ার পরও তাকে স্বেচ্ছায় অবসরে যেতে দেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষকের বিরুদ্ধেও এমন অভিযোগ উঠে এবং তাদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
দুদক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে আইনি ও বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করেছিল, কিন্তু গত ১০ বছরেও কোনো মামলা হয়নি। এছাড়াও, একজন সচিবসহ ১৬ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চাকরিতে যোগদানের সময় নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা না করে পরে সনদ নেওয়ার অভিযোগ উঠে, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সাবেক উপসচিব শেখ আলাউদ্দিন ভুল ব্যাখ্যা ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সনদ গ্রহণ করেন। এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ফৌজদারি মামলা দায়েরের জন্য নির্দেশনা ছিল। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল, কিন্তু কোনো অগ্রগতি হয়নি, বরং তিনি পেনশনের টাকা নিয়ে বাড়ি চলে যান।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের সাবেক প্রধান শেখ হেমায়েত হোসেন মিয়া দীর্ঘদিন ধরে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা গ্রহণ করে আসছিলেন। তিনি সরকারি কর্মচারী (অবসর) আইন অনুযায়ী ৫৯ বছর বয়সে অবসর গ্রহণ করেন, কিন্তু ভাতার টাকা ফেরত দেননি।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, যারা জাল সনদ গ্রহণ করেছেন এবং যারা সুপারিশ করেছেন তাদের সকলের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
দণ্ডবিধির ৪১৬ ধারা অনুযায়ী, প্রতারণার মাধ্যমে কারও অনুকরণ করে কোনো কাজ করা একটি যোগ্য অপরাধ এবং যদি কেউ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করেন তাহলে তা একটি অপরাধ। এছাড়াও, ভুয়া তথ্য প্রদানের জন্য তিন বছর কারাদণ্ড অথবা জাল মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেখিয়ে সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের জন্য সাত বছর কারাদণ্ড হতে পারে। কেউ যদি জাল মুক্তিযোদ্ধার সনদ গ্রহণ করেন তাহলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেবে।
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১০ হাজার ৮১৭ জনকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য সুপারিশ করেছে। এই তালিকায় সাবেক মন্ত্রী এবং আইনপ্রণেতাদের নামও রয়েছে। এদিকে, ২ হাজার ১৯০ জনের গেজেট বাতিল করা হয়েছে।
গত বছর ১১ এপ্রিল এক সভায় বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান মেয়র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহর নাম গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় জামুকা। পরবর্তী সভায় তৎকালীন গাইবান্ধা-৪ আসনের সংসদ সদস্য মনোয়ার হোসেন চৌধুরীর নাম গেজেটে যুক্ত করার জন্য আরেকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
স্বাধীনতার ৫২ বছরে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে নাম যুক্ত ও বাদ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে কমপক্ষে সাতবার। এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য বয়স, সংজ্ঞা এবং মানদণ্ড পরিবর্তন করা হয়েছে ১১ বার।
বর্তমানে একজন মুক্তিযোদ্ধা প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা ভাতা পেয়ে থাকেন। এছাড়াও, তারা দুই ঈদে ২০ হাজার টাকা, ১০ হাজার টাকা করে, বিজয় দিবসে ৫ হাজার টাকা এবং বাংলা নববর্ষে ২ হাজার টাকা পেয়ে থাকেন। সর্বমোট একজন ব্যক্তি প্রতি বছর প্রায় ২ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা পেয়ে থাকেন।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নিরীক্ষণ কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির এ বিষয়ে বলেন, যারা জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে এবং মিথ্যা তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সনদ গ্রহণ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা উচিত। শুধুমাত্র সনদ বাতিল করা অথবা ভাতার টাকা আদায় কোনো শাস্তি নয়।
প্রথম আলো থেকে অনূদিত
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.