অর্থনীতি: গতি ফিরলেও, স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে

কঠোর নিষেধাজ্ঞার পর শিল্প কারখানা খুলে দেওয়ায় দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আবারও গতি ফিরে পেতে শুরু করেছে। তবে এখনও ব্যবসা পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। সারাদেশে চলমান কারফিউ, সীমিত ইন্টারনেট সেবা এবং ব্যাংকিং লেনদেনের সীমিত সুযোগ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে।

চট্রগ্রাম বন্দর

পাঁচ দিন বন্ধ থাকার পর বুধবার এবং বৃহস্পতিবার ব্যাংকগুলো সীমিত সংখ্যক শাখা দৈনিক চার ঘণ্টার জন্য খুলে দেয়। এতে গ্রাহকদের তীব্র চাপের মুখে পড়তে হয়। চট্টগ্রাম বন্দরেও আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম শুরু হলেও আমদানিকৃত পণ্য ছাড়ের জন্য তীব্র চাপ লক্ষ্য করা গেছে।

গত ১৫ জুলাই কোটা সংস্কারের দাবিতে সংঘর্ষের পর ১৮ জুলাই থেকে ইন্টারনেট সেবা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে বন্দরে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে।

পরবর্তী ঘটনাক্রমে ১৯ জুলাই থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সারাদেশে কারফিউ ঘোষণা করা হলে সকল শিল্প কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

পরে ব্যবসায়ী নেতাদের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ২৩ জুলাই, মঙ্গলবার থেকে চট্টগ্রামের কারখানাগুলো খুলে দেওয়ার অনুমতি দেয়। বুধবার থেকে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী এবং ভালুকাসহ বিভিন্ন এলাকার কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বেশিরভাগ শ্রমিক কাজে ফিরে এসেছেন।

তবে রপ্তানিমুখী পোশাক, পুটওয়্যার, প্লাস্টিক পণ্য, ইস্পাত, সিমেন্ট এবং ভোগ্যপণ্য খাত কাঁচামালের অভাবে সমস্যায় পড়েছে।

ব্যবসায়ীদের মতে, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আমদানিকৃত কাঁচামাল পরিবহন এখনও স্বাভাবিক হয়নি। ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের স্বল্পতার কারণে পরিবহন খরচও বেড়ে গেছে। ইন্টারনেট সংযোগ বিঘ্নিত হওয়ার কারণে অনলাইনে ক্রয়াদেশ গ্রহণেও সমস্যায় পড়ছে অনেক কোম্পানি। ব্যাংকিং কার্যক্রম সীমিত থাকায় আর্থিক লেনদেনেও সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।

তৈরি পোশাক শিল্পে উদ্বেগ

প্যাসিফিক জিন্স বুধবার থেকে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (সিইপিজেড) তার নয়টি পোশাক কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করেছে। কোম্পানির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, কারফিউয়ের কারণে তাদের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। তিনি ধারণা করছেন, উৎপাদন স্বাভাবিক করতে আরও দুই মাস সময় লাগবে।

প্যাসিফিক জিন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ এম. তানভীর বলেন, “কারখানা বন্ধ থাকায় আমরা সময়মতো কয়েকটি অর্ডারকৃত পণ্য সরবরাহ করতে পারিনি। আমরা উৎপাদনে পিছিয়ে আছি। ইন্টারনেট পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর আমরা ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছি। কিছু ক্ষেত্রে আমাদের ছাড় দিতে হতে পারে।"

এমবি নিট ফ্যাশন দু'দিন আগে নারায়ণগঞ্জে তাদের কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করেছে। তবে তারা এখনও চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আমদানিকৃত কাপড়ের আটটি কন্টেইনার পরিবহনে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে।

কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিজিএমইএর কার্যনির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, সাধারণ ছুটি, কারফিউ এবং ইন্টারনেট বিঘ্নের কারণে বন্দর বন্ধ থাকায় কর্তৃপক্ষ তাদের কাছ থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেছে।

তিনি আরও জানান, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব জরিমানা মওকুফের আশ্বাস দিলেও তারা জরিমানার সম্মুখীন হয়েছেন। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের আবেদন করার পরামর্শ দিয়েছে।

অন্যান্য শিল্পেও বিঘ্ন

কাঁচামালের অভাবে ন্যাশনাল পলিমার গ্রুপ টঙ্গীর কারখানায় প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনে বিঘ্নের সম্মুখীন হয়েছে। তারা জানিয়েছে, কাঁচামালের প্রায় ৯০টি কন্টেইনার এখন চট্টগ্রাম বন্দরে আটকা পড়ে আছে।

ন্যাশনাল পলিমার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াদ মাহমুদ জানান, উৎপাদন এবং বিক্রয় উভয় ক্ষেত্রেই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে তারা। সীমিত ইন্টারনেটের কারণে অনলাইনে ক্রয়াদেশ গ্রহণেও ব্যাঘাত ঘটছে।

নির্মাণ সামগ্রী খাতের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী আনোয়ার গ্রুপের ব্যবসা স্বাভাবিক সময়ের ২০-২৫ শতাংশে নেমে এসেছে। কোম্পানির চেয়ারম্যান মানোয়ার হোসেনও জানান, সীমিত ইন্টারনেট সংযোগের কারণে তারা ক্রয়াদেশ গ্রহণে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।

বহুজাতিক ভোগ্যপণ্য কোম্পানি ইউনিলিভার বাংলাদেশ জানিয়েছে, তাদের বিক্রয় স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ৫০ শতাংশ কমে গেছে। তবে তাদের কারখানাগুলোতে উৎপাদন প্রায় স্বাভাবিক।

কোম্পানির চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাবেদ আখতার প্রথম আলোকে বলেন, ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় তারা গত কয়েক দিন ধরে তাদের কারখানা থেকে কোনও পণ্য সরবরাহ করতে পারেনি।

এই পরিস্থিতিতে, বিশেষজ্ঞরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছেন।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অব ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে অর্থনীতি যেখানে সঙ্কটে রয়েছে সেখানে একটি ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে। ভবিষ্যতে অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার উপর নির্ভর করছে।

প্রথম আলো থেকে অনূদিত