দেশজুড়ে পুলিশি বাধার মুখে শিক্ষার্থীদের ‘মার্চ ফর জাস্টিস’

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড, গণগ্রেপ্তার, হামলা, মামলা এবং জোরপূর্বক গুমের প্রতিবাদে বুধবার দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেছে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা।

মার্চ ফর জাস্টিসের ছবি

‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহতদের ন্যায়বিচার ও বিক্ষোভকারীদের হয়রানি বন্ধের দাবিতে দেশজুড়ে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালনের ডাক দেয়। এরই অংশ হিসেবে এই বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়।

ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী এবং সিলেটে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা শিক্ষক এবং অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়ে এই মিছিল ও বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নেয়।

বেশিরভাগ স্থানেই পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে বাধা দেয়, লাঠিচার্জ করে, কাঁদানে গ্যাসের শেল এবং সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

দুপুরে ঢাকায় হাইকোর্ট সংলগ্ন মাজার গেট এলাকায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পুলিশ সেখান থেকে বেশ কয়েকজনকে আটক করে।

আটকের ঘটনার পরও বিক্ষোভকারীরা প্রায় তিন ঘন্টা ওই এলাকায় অবস্থান করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। অধ্যাপক লুৎফর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও কয়েকজন শিক্ষককে নিয়ে এই কর্মসূচিতে অংশ নেন। এদিকে হাইকোর্ট চত্বরে আইনজীবীদের একটি অংশ মিছিল করে।

দুপুর ১টার দিকে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের একটি অংশ হাইকোর্ট চত্বরে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এক পর্যায়ে তারা দোয়েল চত্বর এলাকায় অবস্থান নেয় এবং শহীদ মিনারে সমাবেশের মাধ্যমে তাদের বিক্ষোভ কর্মসূচির সমাপ্তি ঘটায়।

তারা বিকেল ৩টার দিকে এলাকা ত্যাগ করে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে। বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীরা দুপুর ১টার দিকে ক্যাম্পাসের মহুয়া মঞ্চে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ ও গণস্বাক্ষর কর্মসূচি পালন করে।

তারা সেখান থেকে একটি মিছিল বের করে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় মহুয়া মঞ্চে ফিরে আসে এবং সমাবেশ করে। বিভিন্ন বিভাগের ১০-১৫ জন শিক্ষক এই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে যোগদান করেন।

সিলেট

সিলেট নগরীর সুবিদবাজার এলাকায় বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীরা দুপুর ১টার দিকে একটি মিছিল বের করলে পুলিশ তাদের ওপর কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সমন্বয়কারী ফয়সাল হোসেন জানান, পুলিশের এই হামলায় কমপক্ষে ২০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ‘মার্চ ফর জাস্টিস' কর্মসূচি পালনের জন্য সকাল ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের পাশে শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়। পুলিশ তাদেরকে সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়কে যাওয়ার অনুমতি না দেওয়ায় বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা কাছের একটি ওভারব্রিজের নিচে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকে।

দুপুর ১২টার দিকে তারা সিলেট নগরীর দিকে একটি মিছিল বের করে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তারা যখন সুবিদবাজার এলাকায় পৌঁছায়, তখন পুলিশ তাদের গতিরোধ করে এবং উভয়পক্ষের মধ্যে ব্যাপক ধস্তাধস্তি শুরু হয়।

এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা পুলিশের বাধা অতিক্রম করে আদালত পয়েন্ট এলাকার দিকে অগ্রসর হলে পুলিশ সেখানে অবস্থান নিয়ে তাদের ওপর কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। জবাবে শিক্ষার্থীরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে।

খুলনা

খুলনার রয়েল মোড়ে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। একপর্যায়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে যখন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা পুলিশের দিকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে।

শিক্ষার্থী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষে সাত রাস্তা ও রয়েল মোড় এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।

খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোজাম্মেল হক জানান, শিক্ষার্থীরা হাতে লাঠিসোটা নিয়ে গাড়ি ভাংচুর ও রাস্তা অবরোধ করে সরকারি সম্পত্তির ক্ষতি করার চেষ্টা করলে পুলিশ ব্যবস্থা নেয়।

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ধারণা, বিক্ষোভকারীদের একটি বড় অংশ নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াত ও শিবিরের লোকজন। কিছু শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছে। তাদের বিষয়ে যাচাই-বাছাই করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

বরিশাল

বরিশালে পুলিশ ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া বিক্ষোভকারীদের ওপর লাঠিচার্জ করেছে। এতে কমপক্ষে ১০ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে চারজন সাংবাদিক রয়েছেন। পুলিশ বেশ কিছু বিক্ষোভকারীকে আটক করেছে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও বিক্ষোভকারীরা জানান, সকাল ১১টার দিকে নগরীর কাঠপট্টি রোডে একদল শিক্ষার্থী ও কিছু অভিভাবক মিছিল বের করতে চাইলে পুলিশ তাদের বাধা প্রদান করে। এ নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে ধস্তাধস্তির সৃষ্টি হয়।

পুলিশের বাধা ডিঙিয়ে বিক্ষোভকারীরা সামনে অগ্রসর হলে সিটি কলেজ গলির মুখে পুলিশ তাদের গতিরোধ করে। এসময় আরও কিছু শিক্ষার্থী যুক্ত হয়ে সদর রোডে অবস্থান নিতে চাইলে পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এসময় শিক্ষার্থীরা তাদের বিভিন্ন দাবি নিয়ে স্লোগান দিতে থাকে।

এসময় উপস্থিত কয়েকজন সাংবাদিক অভিযোগ করেন, তাদেরকে ও পুলিশ মারধর করেছে। এতে কমপক্ষে চারজন সাংবাদিক আহত হন। পরে সাংবাদিকদের ওপর পুলিশের এই সকল সন্ত্রাসের প্রতিবাদে তারা সড়কে অবস্থান নেন।

বিক্ষোভকারীরা অভিযোগ করেন, ফজলুল হক এভিনিউ অভিমুখে বিচারক আদালতের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা কালে পুলিশ আবারো তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে। এতে কমপক্ষে চারজন বিক্ষোভকারী আহত হন এবং কিছু বিক্ষোভকারীকে আটক করা হয়।

চট্টগ্রাম

দেশব্যাপী ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে চট্টগ্রামে ও বিক্ষোভ মিছিল বের করে শিক্ষার্থীরা। পুলিশের বাধা অমান্য করে শিক্ষার্থীরা আদালত প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে ও সেখানে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। পরে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা তাদের সঙ্গে যোগ দেন।

বৃষ্টি উপেক্ষা করে বিক্ষোভকারীরা দুপুর ১২টা পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে। এক পর্যায়ে সরকার পক্ষের আইনজীবীরা তাদের বাধা প্রদান করলে উভয় পক্ষের মধ্যে সামান্য ধস্তাধস্তি হয়। তবে কোন বড় ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি।

এর আগে সকাল ১০টা ৩০ মিনিটের দিকে জহুর হকার মার্কেট সংলগ্ন আদালত গেটের সামনে শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে শুরু করে। সেখানে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন থাকায় শিক্ষার্থীরা জেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং সংলগ্ন সড়ক অবরোধ করে।

রাজশাহী

রাজশাহী নগরীর আদালত এলাকায় বিক্ষোভকারীরা কর্মসূচি পালন করবে এমন সংবাদ পেয়ে সেখানে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। সেখানে বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়। তবে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কোন বিক্ষোভকারী সেখানে কর্মসূচি পালন করতে যায়নি।

অপরদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জাতীয়তাবাদী শিক্ষক মঞ্চের পক্ষ থেকে এক সমাবেশে বক্তারা বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের প্রতি ঐক্যবদ্ধতার কথা বলেন। তারা কোটা সংস্কারের ৯ দফা দাবি মেনে নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানান।

প্রথম আলো অবলম্বনে