সুদভিত্তিক অর্থনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার এরদোয়ান, চাইলেন মানবিক ও ন্যায়নিষ্ঠ বিকল্প

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেছেন, বর্তমান ‘বিকৃত বৈশ্বিক ব্যবস্থা’ বিশ্বব্যাপী অসমতাকে মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে তুলছে এবং সাধারণ মানুষকে পুঁজিবাদের দাসে পরিণত করছে। তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে জোর দিয়ে বলেন, ‘আমি বারবার বলেছি, আমরা কোনোভাবেই সুদ বা সুদভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বৈধতা দিতে পারি না।’

ভাষণ দিচ্ছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান

শুক্রবার (৩০ মে) ইস্তাম্বুলে আলবারাকা ব্যাংক আয়োজিত দ্বিতীয় গ্লোবাল ইসলামিক ইকোনমি ফোরামে ভাষণ দেওয়ার সময় প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘অতীতে যেমন আমরা বলেছিলাম, ‘পাঁচের চেয়ে বিশ্ব বড়’, তেমনি আজ সুদভিত্তিক এই অবিচারপূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিবর্তনের ব্যাপারেও আমরা দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। আমরা শুধু এ ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েই ক্ষান্ত হব না, বরং এর কার্যকর বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তুলতে এবং তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতেও সক্রিয়ভাবে কাজ করব।’

এরদোয়ান আরও বলেন, ‘আজকের বৈশ্বিক ব্যবস্থা এমন এক কাঠামো তৈরি করেছে, যা সাধারণ মানুষকে সুদের কঠিন বেড়াজালে আবদ্ধ করে ফেলেছে। আমাদের এমন একটি অর্থনৈতিক আদর্শ প্রয়োজন, যা হবে মানবিক, ন্যায়নিষ্ঠ, সহানুভূতিশীল এবং দায়িত্বশীল।’

তিনি মন্তব্য করেন, ‘বর্তমানে প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মূলত ভোগ ও মুনাফার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এর ফলে মানুষের মৌলিক মানবিক মূল্যবোধ উপেক্ষিত হচ্ছে, সমাজে অসাম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং দীর্ঘমেয়াদে তা এক ধরনের অপুষ্ট ও অস্থির প্রবৃদ্ধি তৈরি করছে।’ তাঁর মতে, এই ব্যবস্থা মানবিক মূল্যবোধকে পেছনে ঠেলে দিয়ে অটেকসই প্রবৃদ্ধিকে উৎসাহিত করেছে। এ প্রসঙ্গে তিনি ইসলামি অর্থনীতির ন্যায়ভিত্তিক, ঝুঁকি ভাগাভাগি ও সামাজিক সংহতির নীতিগুলোর ওপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেন।

প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান উল্লেখ করেন, ‘বিশ্বে মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় ২৫ শতাংশ হলেও ইসলামি অর্থনীতির সামগ্রিক পরিমাণ মাত্র ২.৫ ট্রিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে, ৫৭টি মুসলিম দেশের জোট ওআইসি বৈশ্বিক বাণিজ্যের মাত্র ১১ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে। অর্থাৎ, বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ জনসংখ্যা হয়েও আমরা মাত্র নয় শতাংশ অর্থনীতির মালিক।’

নিজেদের মধ্যে অর্থ, বাণিজ্য ও সহযোগিতার সুযোগগুলোকে কাজে লাগানোর ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘ইসলামি অর্থনৈতিক নীতিমালার তিনটি মূল স্তম্ভ—ন্যায়বিচার, ঝুঁকি ভাগাভাগি এবং সামাজিক সংহতি—চলমান বিশ্বব্যবস্থার একটি শক্তিশালী বিকল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে।’

বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য যুদ্ধ, ক্রমবর্ধমান ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, ঋণের বোঝা, বয়স্ক জনসংখ্যার হার বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলো বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করছে বলেও সতর্ক করেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট। তিনি বলেন, ‘তুরস্ক এমন এক ভূখণ্ডে অবস্থিত, যা ইতিহাসে বহু জাতি ও সংস্কৃতির মিলনস্থল হিসেবে পরিচিত। তাই এই অঞ্চলের নেতৃত্বে তুরস্কের ভূমিকা দায়িত্বপূর্ণ ও সক্রিয় হওয়া অপরিহার্য।’

ইস্তাম্বুলকে বৈশ্বিক ইসলামিক অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তুলতে তুরস্ক নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ইস্তাম্বুলকে একটি বৈশ্বিক আর্থিক কেন্দ্রে পরিণত করতে কাজ করছি, যা শুধু তুর্কি নাগরিকদের জন্যই নয়, বরং গোটা ইসলামিক অর্থায়ন বাজারের জন্যই অপার সুযোগ সৃষ্টি করবে।’

দেশের অগ্রগতি ও বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কথা উল্লেখ করে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমরা একযোগে বহু ফ্রন্টে লড়াই করছি। আমাদের ৮৬ মিলিয়ন জনগণের ‘নৌকাকে’ নিরাপদে ও সঠিকভাবে বন্দরে পৌঁছাতে চাই। অনেক বাধা সত্ত্বেও আমরা সাফল্যের সঙ্গেই এগিয়ে চলেছি।’

এ সময় তিনি সিরিয়ার ক্রমস্থিতিশীল পরিস্থিতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তি নিয়ে আলোচনার জন্য ইস্তাম্বুলে বৈঠকের প্রস্তুতি, ফিলিস্তিনে চলমান বর্বরতা বন্ধে তুরস্কের সক্রিয় ভূমিকা এবং দেশের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানোর কথাও তুলে ধরেন। তিনি জানান, সন্ত্রাসবাদের কারণে তুরস্কের ২ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে, তবে এখন তা নির্মূলের দ্বারপ্রান্তে।