লিভারপুলের দীর্ঘ অপেক্ষা: এক দশকের ট্রফি খরা ও একনিষ্ঠ স্মৃতিচারণ
- Details
- by মো: আহসানুল হক খন্দকার
আসুন, আজ মন খুলে কিছু কথা বলি। আমি একজন খাঁটি লিভারপুল সমর্থক। সেই কঠিন বছরগুলো আমি নিজের চোখে দেখেছি। প্রতিটি আনন্দের মুহূর্ত আর প্রতিটি বুক ভাঙা কষ্ট আমি অনুভব করেছি। আমার যেভাবে মনে পড়ে, আমাদের সবার যেভাবে মনে পড়ে, সেটাই আজ তুলে ধরছি।
ঢাকার বুকে লিভারপুল সমর্থকদের বাঁধভাঙা উল্লাস, ২০২৪-২৫ ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা জয় উদযাপনকালে। ছবিতে ট্রফি হাতে উচ্ছ্বসিত লেখক মো: আহসানুল হক খন্দকার...
সত্যি বলতে, এখন ‘লিভারপুল ফ্যান’ শুনলেই সবার আগে ক্লপের সেই চেনা হাসি, প্রিমিয়ার লিগ ট্রফি, অথবা অ্যানফিল্ডের জমকালো চ্যাম্পিয়ন্স লিগ রাতের কথা মনে আসে। হ্যাঁ, এখন আমরা এমনই এক দল, আর এই অনুভূতিটা অসাধারণ। কিন্তু একটা লম্বা সময় ছিল অন্যরকম। ২০০৫ সালে ইস্তাম্বুলে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয় এবং ২০০৬ সালের এফএ কাপ জয়ের পর লিভারপুলের জন্য এক দীর্ঘ ট্রফি খরা শুরু হয়। ইয়ুর্গেন ক্লপ এসে দলের পুনর্জাগরণ ঘটানোর আগ পর্যন্ত, অর্থাৎ ২০০৭ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত, ২০১২ সালের লিগ কাপটি ছাড়া বলার মতো আর কোনো সাফল্য পায়নি দলটি।
লিভারপুলকে সমর্থন করা শুধু আজকের ব্যাপার নয়, এটা একটা ঐতিহ্যের বিষয়। শ্যাঙ্কলি, পেইজলি, ফ্যাগেন, ডালগ্লিশ – এই নামগুলো আমাদের রক্তে মিশে আছে। আমরা তাদের সময়ে ঘরোয়া ও ইউরোপীয় ফুটবলে ক্লাবের দাপটের গল্প শুনে বড় হয়েছি। তাই বছরের পর বছর লিগ ট্রফি না পাওয়াটা খুব কষ্টের ছিল। তার ওপর, আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, তারপর চেলসি, আর তারপর ম্যানচেস্টার সিটিকে একের পর এক ট্রফি জিততে দেখাটা ছিল অসহ্য যন্ত্রণার।
রাফা বেনিতেজের অধীনে ২০০৮-০৯ মৌসুমটা ছিল খুব কষ্টের। আমরা শিরোপার খুব কাছে ছিলাম। তোরেস আর জেরার্ডের দারুণ নৈপুণ্যে দল দুর্দান্ত খেলছিল। কিন্তু মাত্র চার পয়েন্টের জন্য ইউনাইটেডের কাছে হেরে যাওয়াটা বুকে ছুরির মতো লেগেছিল। সেই মৌসুমে আমরা লিগে মাত্র দুটো ম্যাচ হেরেছিলাম! কিন্তু অনেকগুলো ড্র আমাদের স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছিল।
একবার ভাবুন তো, লিভারপুলের মতো দলের অবস্থান যখন লিগ টেবিলে সপ্তম, অষ্টম বা ষষ্ঠ স্থানে থাকত, তখন কেমন লাগত! আর দুটো মৌসুমে দ্বিতীয় স্থান? ওহ, কী যে কষ্ট! বিশেষ করে ২০১৩-১৪ মৌসুমের কথা। ব্রেন্ডন রজার্সের অধীনে আমরা অসাধারণ ফুটবল খেলছিলাম। সুয়ারেজকে থামানো যাচ্ছিল না, স্টারিজ গোল করছিল, স্টার্লিং যেন বিদ্যুতের গতিতে খেলছিল। আমরা ভেবেছিলাম, ‘এটাই সেই বছর! অবশেষে আমরাই জিতব!’ আর তারপর... সেই চেলসির ম্যাচটা, সেই স্লিপ! ক্রিস্টাল প্যালেসের সাথে ড্র। এখনও সেই কথা লিখতে গেলে কষ্ট হয়। এত কাছে এসে, হাতের মুঠোয় পেয়েও ট্রফিটা ফসকে যাওয়াটা যে হতাশা দিয়েছিল, তা আমি আমার ঘোর শত্রুর জন্যও চাই না (অবশ্য, দু-একজনের জন্য চাইতেই পারি!)।
প্রিমিয়ার লিগ অবস্থান (আশা ও হতাশার রোলারকোস্টার)
মৌসুম | প্রিমিয়ার লিগ অবস্থান | ম্যানেজার | |
২০০৪-০৫ | ৫ম | বেনিতেজ | চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ী |
২০০৫-০৬ | ৩য় | বেনিতেজ | এফএ কাপ জয়ী |
২০০৬-০৭ | ৩য় | বেনিতেজ | চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালিস্ট |
২০০৭-০৮ | ৪র্থ | বেনিতেজ | |
২০০৮-০৯ | ২য় | বেনিতেজ | শিরোপার খুব কাছে! |
২০০৯-১০ | ৭ম | বেনিতেজ | পতনের শুরু |
২০১০-১১ | ৬ষ্ঠ | হজসন/ডালগ্লিশ | মৌসুমের মাঝে ম্যানেজার পরিবর্তন |
২০১১-১২ | ৮ম | ডালগ্লিশ | লিগ কাপ জয়ী, এফএ কাপ ফাইনালিস্ট |
২০১২-১৩ | ৭ম | রজার্স | |
২০১৩-১৪ | ২য় | রজার্স | ‘সুয়ারেজ’ মৌসুম, অল্পের জন্য হাতছাড়া |
২০১৪-১৫ | ৬ষ্ঠ | রজার্স | সুয়ারেজ পরবর্তী সময়ে দলের বাজে ফর্ম |
২০১৫-১৬ | ৮ম | রজার্স/ক্লপ | ক্লপ মৌসুমের মাঝে আসেন |
২০১৬-১৭ | ৪র্থ | ক্লপ | চ্যাম্পিয়ন্স লিগে প্রত্যাবর্তন |
২০১৭-১৮ | ৪র্থ | ক্লপ | চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালিস্ট |
রাফার পর ম্যানেজার হিসেবে এলেন রয় হজসন। সেটা ছিল এক অন্ধকার সময়, এটুকুই বলি। ফুটবল ছিল হতাশাজনক, আশার আলো দেখা যাচ্ছিল না। তারপর আমাদের ‘রাজা’ কেনি ডালগ্লিশ দ্বিতীয়বারের জন্য এলেন। ২০১২ সালে লিগ কাপ জেতাটা ছিল একটা স্বস্তির ব্যাপার, সাফল্যের একটুখানি স্বাদ। কিন্তু লিগে দলের অবস্থা তখনও ভালো ছিল না। লিগ কাপ জয় ভালো লেগেছিল, কিন্তু এটা সেই বড় ট্রফি ছিল না, যা আমরা চেয়েছিলাম। ব্রেন্ডন রজার্স এসে আক্রমণাত্মক ফুটবলের ঝলক দেখিয়েছিলেন এবং একটা মৌসুমের জন্য সত্যিকারের শিরোপার স্বপ্নও জাগিয়েছিলেন। কিন্তু ২০১৩-১৪ মৌসুমের সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার পর আর সুয়ারেজের চলে যাওয়ায় মনে হচ্ছিল আমরা আবার পুরোনো অবস্থানে ফিরে গেছি।
আসুন, কঠিন সত্যটা দেখি। ২০০৬ সালে আমাদের এফএ কাপ জয়ের পর থেকে ২০১৯ সালে ক্লপের অধীনে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার আগে পর্যন্ত লিভারপুলের অর্জন ছিল মাত্র ১টি লিগ কাপ (২০১২)। এই সময়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড জিতেছে ৫টি প্রিমিয়ার লিগ, ১টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ১টি এফএ কাপ, ৩টি লিগ কাপ ও ১টি ইউরোপা লিগ। চেলসি জিতেছে ৩টি প্রিমিয়ার লিগ, ১টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ৪টি এফএ কাপ, ১টি লিগ কাপ ও ১টি ইউরোপা লিগ। ম্যানচেস্টার সিটিও ঘরে তুলেছে ৩টি প্রিমিয়ার লিগ, ১টি এফএ কাপ ও ৩টি লিগ কাপ। এই সংখ্যাগুলো দেখলে আজও সেই পুরোনো কষ্টটা ফিরে আসে। প্রতিপক্ষের সমর্থকদের টিটকারি, আর ‘পরের বছর তোমাদের’ বলে করা তামাশাগুলো খুব গায়ে লাগত।
কিন্তু সেই কঠিন বছরগুলোতে একটা জিনিস কখনও কমেনি – সেটা হলো সমর্থকদের ভালোবাসা আর সমর্থন। লিগে দলের ফল যেমনই হোক না কেন, ইউরোপীয় ম্যাচগুলোর রাতে অ্যানফিল্ড সমর্থকদের চিৎকারে ফেটে পড়ত। অ্যাওয়ে ম্যাচের গ্যালারিতেও আমাদের সমর্থকরা ভিড় জমাত, মন খুলে গান গাইত (‘You'll Never Walk Alone’ স্লোগানটি যেন তাদের কাছে নিছক গান নয়, বরং এক প্রতিজ্ঞার নাম), সব খারাপ অবস্থার মধ্যেও বিশ্বাস ধরে রাখত। এটাও তো এক ধরনের জয় ছিল। আমাদের এই একনিষ্ঠ ভালোবাসা, আমাদের আবেগ – সেটাই ছিল তখন আমাদের আসল ট্রফি।
দিনগুলো সত্যিই খুব কষ্টের ছিল। মনে অনেক সন্দেহ আসত, খুব হতাশ লাগতো। নিজেকে প্রশ্ন করতাম, কেন এই কষ্ট সহ্য করছি। কিন্তু পরক্ষণেই ক্লাবের ইতিহাস, ক্লাবের চেতনা আর এই বিশাল সমর্থক পরিবারের কথা মনে পড়ত। কখনও কোনো খেলোয়াড়ের একটুখানি ঝলক, বা একটা জাদুকরী মুহূর্ত দেখলেই আশার সেই ছোট্ট প্রদীপটা আবার জ্বলে উঠত।
অবশেষে ২০১৫ সালের অক্টোবরে যখন ইয়ুর্গেন ক্লপ এলেন, তখন থেকেই যেন সবকিছু বদলাতে শুরু করল। তার সেই বিখ্যাত কথাটা, ‘সন্দেহবাদী থেকে বিশ্বাসী হতে হবে’, আমাদের হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছিল। আমরা শুরুতেই ট্রফি জিতিনি। তার অধীনে আমরা একটা লিগ কাপ ফাইনাল, একটা ইউরোপা লিগ ফাইনাল এবং একটা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল হেরেছি। অবশেষে আমাদের অপেক্ষার অবসান হয়েছে। কিন্তু ক্লপের অধীনে এই যাত্রাটা অন্যরকম মনে হচ্ছিল। একটা পরিষ্কার পরিকল্পনা ছিল, একটা নতুন উদ্দীপনা ছিল। ম্যানেজার, খেলোয়াড় এবং সমর্থকদের মধ্যে এমন একটা আত্মিক যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল, যা আগে কখনও দেখিনি।
সেই ট্রফি ছাড়া বছরগুলো খুব কষ্টের ছিল। কিন্তু সেই কষ্টই ক্লপের অধীনে পাওয়া সাফল্যগুলোকে আরও মিষ্টি করে তুলেছে। আমরা শুধু ভাগ্যের জোরে সাফল্য পাইনি। এই জায়গায় আসতে আমাদের অনেক লম্বা আর কঠিন পথ পার হতে হয়েছে। আর আমাদের মধ্যে যারা সেই কঠিন সময়েও বিশ্বাস হারায়নি, তারা জানে এই সাফল্যের মূল্য কতটা। আমরা এটা অর্জন করেছি, আমাদের একনিষ্ঠ সমর্থন আর হার না মানা মানসিকতার জোরে।
ক্লপের প্রস্থান এবং আর্নে স্লটের আগমন নিয়ে আরেকদিন লিখব।
লেখক: মো. আহসানুল হক খন্দকার
বেসরকারি চাকরিজীবী এবং ফ্রিল্যান্স রাইটার
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.