ইরানে ইসরায়েলের হামলা: সর্বশেষ পরিস্থিতি ও সম্ভাব্য পরিণতি

ইসরায়েল ইরানের একাধিক পারমাণবিক স্থাপনা ও সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে। একইসঙ্গে দেশটির শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানীদের গুপ্তহত্যা করা হয়েছে। শুক্রবার সকালে প্রথম দফায় এই হামলা চালানো হয়। পরে, স্থানীয় গণমাধ্যম ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় তাবরিজ শহরে দ্বিতীয় দফায় পৃথক হামলার খবর জানায়।

ছবি - সংগৃহীত

এই আগ্রাসনের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে একটি বড় আকারের সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তেহরান এর ‘কঠোর জবাব’ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, এই হামলার পর ইসরায়েলকে ‘তিক্ত ও বেদনাদায়ক’ পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর ইচ্ছায়, ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীর শক্তিশালী হাত একে (ইসরায়েলকে) শাস্তি না দিয়ে ছাড়বে না।’

অন্যদিকে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক পূর্ব-রেকর্ড করা বার্তায় বলেছেন, শুক্রবারের হামলা ইরানের পারমাণবিক অবকাঠামো এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কারখানাগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করার লক্ষ্যে চালানো হয়েছে।

ইসরায়েল কোথায় কোথায় হামলা চালিয়েছে?

নিম্নলিখিত স্থানগুলোতে হামলার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে:

• রাজধানী তেহরান এবং এর আশেপাশের সামরিক ঘাঁটি।
• নাতাঞ্জ শহর, যেখানে প্রধান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রে বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে।
• তাবরিজ শহর, যেখানে একটি পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র এবং দুটি সামরিক ঘাঁটির কাছে বিস্ফোরণের খবর মিলেছে।
• তেহরানের দক্ষিণে ইসফাহান শহর।
• তেহরানের দক্ষিণ-পশ্চিমে আরাক শহর।
• তেহরানের পশ্চিমে কেরমানশাহ শহর।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে ইরানের রাজধানীজুড়ে আবাসিক ভবনসহ বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত কাঠামোর চিত্র দেখা গেছে।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানায় যে তারা নাতাঞ্জ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রের ভূগর্ভস্থ স্থাপনার ক্ষতি করেছে। এর মধ্যে রয়েছে সেন্ট্রিফিউজসহ একটি বহুতল সমৃদ্ধকরণ হল, বৈদ্যুতিক কক্ষ এবং অন্যান্য সহায়ক অবকাঠামো।

তারা আরও যোগ করে, ‘কেন্দ্রটির গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে হামলা করা হয়েছে, যা ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের প্রকল্পকে এগিয়ে নিতে সহায়ক ছিল।’

নিহত হয়েছেন কারা?

ইরানি গণমাধ্যম অনুসারে, ইসরায়েলি হামলায় নিহতদের মধ্যে ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের কমান্ডার-ইন-চিফ হোসেইন সালামি এবং ইরানের সামরিক বাহিনীর চিফ অফ স্টাফ মোহাম্মদ বাঘেরি রয়েছেন।

রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা নূর নিউজ জানিয়েছে, খামেনির উপদেষ্টা আলি শামখানি ‘গুরুতরভাবে আহত’ হয়েছেন।

তাসনিম সংবাদ সংস্থার মতে, খাতাম আল-আম্বিয়া সদর দপ্তরের কমান্ডার মেজর জেনারেল গোলামালি রশিদ নিহত হয়েছেন।

রাজধানী তেহরান থেকে আল জাজিরার প্রতিবেদক তোহিদ আসাদি জানিয়েছেন, সামরিক কর্মকর্তাদের পাশাপাশি শীর্ষস্থানীয় দুই পরমাণু বিজ্ঞানী ফেরিদুন আব্বাসি এবং মোহাম্মদ তেহরানচিকেও গুপ্তহত্যা করা হয়েছে। আব্বাসি ইরানের আণবিক শক্তি সংস্থার প্রাক্তন প্রধান ছিলেন এবং তেহরানচি ইসলামিক আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ছিলেন।

ইরানের প্রতিক্রিয়া

ইরানের জনগণ ঘুম থেকে উঠে তাদের এলাকায় ধ্বংসের ভয়াবহ দৃশ্য দেখেছে।

এক বিবৃতিতে খামেনি বলেন, ইসরায়েল ইরানের বিরুদ্ধে ‘অপরাধে তার নোংরা ও রক্তাক্ত হাত বাড়িয়েছে’ এবং আবাসিক কেন্দ্রে হামলা করে তার দুষ্ট প্রকৃতি আগের চেয়ে আরও বেশি প্রকাশ করেছে। তিনি বলেন, ‘এই শাসক গোষ্ঠীকে কঠোর শাস্তির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।’

ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর মুখপাত্র আবুলফজল শেকারচিকে উদ্ধৃত করে ইরানি গণমাধ্যম জানিয়েছে, ইসরায়েলকে এই হামলার জন্য ‘চড়া মূল্য’ দিতে হবে।

ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া

ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর চিফ অফ স্টাফ ইয়াল জামির বলেছেন, শুক্রবারের হামলার মাধ্যমে ইসরায়েল এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখান থেকে ফেরার কোনো পথ নেই।

ইরানে ভোরের এই হামলাকে ‘অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই’ হিসেবে বর্ণনা করে জামির বলেন, ইসরায়েল এই হামলা চালিয়েছে কারণ ‘আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করার সময় ছিল না।’

তিনি আরও বলেন, ‘যে কেউ আমাদের চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা করবে, তাকে চড়া মূল্য দিতে হবে।’

ইসরায়েলের বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদ ইয়ার লাপিদ এক্সে (সাবেক টুইটার) এক পোস্টে হামলার জন্য ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া কী?

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে আলোচনা চলছে, যার লক্ষ্য ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিনিময়ে দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করা।

ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ইসরায়েলের এই হামলায় ওয়াশিংটন জড়িত ছিল না।

ট্রাম্প বলেন, ‘ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারবে না, এবং আমরা আলোচনার টেবিলে ফিরে আসার আশা করছি। আমরা দেখব কী হয়।’ তিনি আরও যোগ করেন, ইরান পাল্টা হামলা চালালে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে রক্ষা করতে সাহায্য করবে।

হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, ট্রাম্প শুক্রবার সকালে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের একটি বৈঠক ডাকতে পারেন।

এক বিবৃতিতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছেন, এই অভিযানে যুক্তরাষ্ট্র জড়িত ছিল না। রুবিও বলেন, ‘এই অঞ্চলে আমেরিকান বাহিনীকে রক্ষা করাই আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই: ইরানের উচিত মার্কিন স্বার্থ বা কর্মীদের লক্ষ্যবস্তু না করা।’

বিরোধী ডেমোক্রেটিক সিনেটর ক্রিস মারফি বলেছেন, ইরানের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বানচাল করার জন্যই ইসরায়েলের এই হামলা চালানো হয়েছে।

পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার ঝুঁকি কী?

পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা হলে তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানো, বিস্ফোরণ এবং দীর্ঘমেয়াদী দূষণসহ বিভিন্ন অপ্রত্যাশিত পরিণতির ঝুঁকি থাকে।

আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ)-এর প্রধান রাফায়েল গ্রোসি বলেছেন, জাতিসংঘের এই সংস্থাটি ইরানের পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তিনি নিশ্চিত করেছেন যে, ইসরায়েলের লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে নাতাঞ্জ সাইটটিও ছিল।

তিনি বলেন, ‘তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা নিয়ে সংস্থাটি ইরানি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। আমরা দেশে থাকা আমাদের পরিদর্শকদের সঙ্গেও যোগাযোগ করছি।’

বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়া

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে ইসরায়েলি হামলার পর ‘গভীরতর সংঘাত এড়াতে’ ‘সর্বোচ্চ সংযম’ প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন। তার উপ-মুখপাত্র ফারহান হক বলেন, ‘মহাসচিব মধ্যপ্রাচ্যে যেকোনো ধরনের সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধির নিন্দা জানান।’

যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী দেশ ওমান ইসরায়েলের এই পদক্ষেপকে জাতিসংঘের সনদের ‘প্রকাশ্য লঙ্ঘন’ এবং ‘বিপজ্জনক ও বেপরোয়া উত্তেজনা’ বলে অভিহিত করেছে।

ওমান বলেছে, ‘এই ধরনের আগ্রাসী আচরণ অগ্রহণযোগ্য এবং এটি আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তাকে আরও অস্থিতিশীল করে তোলে। ওমান এই উত্তেজনার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করছে এবং এই বিপজ্জনক কর্মকাণ্ড বন্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একটি দৃঢ় ও দ্ব্যর্থহীন অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।’

সূত্র: আল জাজিরা এবং বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা