মধ্যপ্রাচ্যের আকাশপথ অবরুদ্ধ, দিশেহারা হাজারো মানুষ

ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান পাল্টাপাল্টি হামলায় মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন ও অস্থিতিশীল অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। এই তীব্র উত্তেজনার সরাসরি প্রভাব পড়েছে এ অঞ্চলের বিমান চলাচল ব্যবস্থায়। একের পর এক দেশ তাদের আকাশপথ বন্ধ করে দেওয়ায় সৃষ্টি হয়েছে এক নজিরবিহীন অচলাবস্থা। এর ফলে বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার পর্যটক, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী ও সাধারণ যাত্রী বিভিন্ন বিমানবন্দরে আটকা পড়েছেন এবং এক চরম মানবিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছেন।

ছবি - সংগৃহীত

ইরানের কোম প্রদেশে হোটেলের কাছে ইসরায়েলি হামলার পর থেকেই দেশে ফেরার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন ৫৫ বছর বয়সী আফগান ব্যবসায়ী আইমল হুসেন। কিন্তু ইরানের আকাশপথ সম্পূর্ণ বন্ধ থাকায় তিনি কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। হামলা থেকে বাঁচতে তেহরানে আশ্রয় নিলেও, সংঘাত তীব্র হওয়ায় কোনো ট্যাক্সিচালক তাকে সীমান্তে নিয়ে যেতে রাজি হচ্ছেন না। সোমবার এক সেলফোন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘ফ্লাইট, বাজার—সবকিছু বন্ধ। আমি একটি ছোট হোটেলের বেসমেন্টে আশ্রয় নিয়েছি। ট্যাক্সি নিয়ে সীমান্তে যাওয়ার চেষ্টা করছি, কিন্তু কেউ আমাদের নিতে চাইছে না।’

ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার এই ছায়াযুদ্ধ এখন সরাসরি সংঘাতে রূপ নিয়েছে। ইসরায়েলের হামলায় ইরানের রাজধানী তেহরানসহ বিভিন্ন স্থানে দেশটির ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানীরা নিহত হয়েছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে বলে জানা গেছে। এর জবাবে ইরানও শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে পাল্টা হামলা চালিয়েছে। প্রতি রাতে দুই দেশের আকাশসীমা জুড়ে হামলার এই মহড়া এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মনে ব্যাপক আতঙ্ক তৈরি করেছে।

এই সংঘাতের জেরে মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ দেশ তাদের আকাশপথ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। কয়েক ডজন বিমানবন্দর তাদের কার্যক্রম সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে স্থগিত করেছে। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে এক বিশাল অচলাবস্থা। অবসরপ্রাপ্ত পাইলট ও বিমান চলাচল নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ জন কক্সের মতে, ‘এই সংকটের প্রভাব মারাত্মক এবং এর আর্থিক মূল্য হবে বিপুল। হাজার হাজার যাত্রী, বিমানের ক্রু এবং উড়োজাহাজ—সবাই এখন ভুল জায়গায় আটকা পড়েছে।’

নিউইয়র্ক থেকে ইসরায়েলগামী একটি ফ্লাইটে ছিলেন জভিকা বার্গ। বিমানটি অবতরণের ঠিক আগে পাইলট ঘোষণা করেন, ফ্লাইটটি সাইপ্রাসের লার্নাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করবে। এখন তিনি লার্নাকার একটি হোটেলে বসে জেরুজালেমে থাকা তার স্ত্রীর সাথে কথা বলছেন এবং পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য অপেক্ষা করছেন। ইসরায়েলের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বেন গুরিয়ন ‘পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত’ বন্ধ ঘোষণা করায় ৫০ হাজারের বেশি ইসরায়েলি বিদেশে আটকা পড়েছেন।

একইভাবে, তেল আবিবের একটি হোটেলে আটকা পড়েছেন মাহালা ফিনকেলম্যান। তার এয়ার কানাডার ফ্লাইট বাতিল হয়ে গেছে। ইরানের রাতের হামলার সময় হোটেলের ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে আশ্রয় নিয়ে তিনি কানাডায় থাকা তার উদ্বিগ্ন পরিবারকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শুনতে পাই। মাঝে মাঝে পুরো ভবন কেঁপে ওঠে। টেলিভিশনে যা দেখি, তার চেয়ে বাস্তবে মাথার ওপর ঘটে যাওয়া ঘটনা অনেক বেশি ভয়ঙ্কর।’

শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগও চরমে। ইরানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত হাজার হাজার ভারতীয় শিক্ষার্থীর একজন আরসালান আহমেদ। হামলা ও বিস্ফোরণের আতঙ্কে তিনি এবং তার বন্ধুরা হোস্টেল থেকে বের হতে পারছেন না। তিনি বলেন, ‘টেলিভিশনে যা দেখছি তা এমনিতেই ভীতিকর, কিন্তু কিছু কান ফাটানো বিস্ফোরণের শব্দ আরও বেশি ভয়ংকর।’

সংকট এতটাই গভীর যে অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্থলপথে বাড়ি ফেরার চেষ্টা করছেন। ইরাকি ছাত্র ইয়াহিয়া আল-সুরাইফি ইরানের তাবরিজ শহরে পড়াশোনা করতেন, যেখানে ইসরায়েল বিমানবন্দর ও তেল শোধনাগারে বোমা হামলা চালিয়েছে। তিনি এবং তার বন্ধুরা মিলে ট্যাক্সি ভাড়া করে রাতের অন্ধকারে ড্রোন ও বিমান হামলার মধ্যেই প্রায় ৩২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ইরাক সীমান্তে পৌঁছেছেন। তিনি বলেন, ‘রাতের আকাশে সবকিছু আতশবাজির মতো মনে হচ্ছিল। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম।’

তেহরানে আটকে পড়া আফগান ব্যবসায়ী আইমল হুসেনের জন্য এই পরিস্থিতি যেন পুরনো ক্ষতে নুনের ছিটা। তিনি বলেন, ‘আফগানিস্তানে ২০ বছরের যুদ্ধের স্মৃতি এখনো তাজা। কাবুলের পর এবার ইরানে—এই নিয়ে দ্বিতীয়বার আমি এমন ভয়ংকর যুদ্ধ আর কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে আটকা পড়লাম।’

আরব নিউজ অবলম্বনে