এবার ‘মাছি-সৈন্য’ নামাচ্ছে আমেরিকা!

মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে একটি আস্ত গরু মেরে ফেলতে সক্ষম এক ভয়ংকর মাংসখেকো পোকার আক্রমণে বিপর্যস্ত যুক্তরাষ্ট্র। নিউ ওয়ার্ল্ড স্ক্রুওয়ার্ম নামের এই প্রাণঘাতী শূককীটের (লার্ভা) দাপটে মেক্সিকো ও দক্ষিণ টেক্সাসের খামার শিল্পে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। গৃহপালিত পশু থেকে শুরু করে বন্য প্রাণী— কেউই রেহাই পাচ্ছে না এর আক্রমণ থেকে। এই সংকটময় পরিস্থিতি সামাল দিতে এবার এক অভিনব জৈবিক নিয়ন্ত্রণ কৌশল গ্রহণ করেছে মার্কিন কৃষি বিভাগ। আকাশপথে ‘মাছি-সৈন্য’ নামিয়ে এই পোকা নির্মূলের পরিকল্পনা নিয়েছে দেশটি।

এবার মাছির ওপরই ভরসা করছে আমেরিকা

স্ক্রুওয়ার্মের জীবনচক্র বেশ ভয়ংকর। স্ত্রী মাছি জীবন্ত প্রাণীর ক্ষতস্থানে ডিম পাড়ে। সেই ডিম ফুটে জন্ম নেওয়া শূককীটগুলো দ্রুত জীবন্ত মাংস খাওয়া শুরু করে। এদের খাওয়ার গতি এতটাই বেশি যে, একটি বিশাল আকৃতির গরুও কয়েক দিনের মধ্যে মারা যায়।

এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র বন্ধ্যাকৃত বা নির্বীজ পুরুষ মাছি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, কোটি কোটি বন্ধ্যাকৃত পুরুষ মাছি বিমানে করে উপদ্রুত এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়া হবে। এই প্রজাতির স্ত্রী মাছি জীবনে মাত্র একবার সঙ্গমে মিলিত হয়। বন্ধ্যাকৃত পুরুষ মাছির সঙ্গে মিলনের ফলে তাদের ডিম নিষিক্ত হবে না, ফলে নতুন করে শূককীটের জন্ম রোধ করা সম্ভব হবে।

এই কৌশল অবশ্য নতুন নয়। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পানামায় একই পদ্ধতি ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র সাফল্য পেয়েছিল। সে সময় কোটি কোটি বন্ধ্যাকৃত মাছি ছড়িয়ে স্ক্রুওয়ার্মের বংশবিস্তার পুরোপুরি নির্মূল করা হয়েছিল। এবার সেই পুরোনো পরীক্ষিত পথেই হাঁটছে দেশটি।

ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী পরজীবী বিশেষজ্ঞ এডউইন বার্গেস বলেন, “রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার না করে শূককীট নির্মূলের এই পদ্ধতি অনেক বেশি নিরাপদ। কারণ, রাসায়নিক প্রয়োগ করলে তা মানুষসহ পরিবেশের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।”

মার্কিন কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আগামী বছর দক্ষিণ মেক্সিকোতে একটি বিশাল প্রজননকেন্দ্র চালু করা হবে। পাশাপাশি দক্ষিণ টেক্সাসেও একই ধরনের একটি কেন্দ্র তৈরির কাজ চলছে। বর্তমানে পানামার পুরোনো কারখানায় প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১১ কোটি ৭০ লাখ বন্ধ্যাকৃত মাছি উৎপাদন করা সম্ভব হলেও যুক্তরাষ্ট্রের নতুন লক্ষ্য প্রতি সপ্তাহে ৪০ কোটি মাছি উৎপাদন করা। এই লক্ষ্যে নতুন কারখানা স্থাপনের জন্য প্রায় ৩ কোটি ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে।

এই মাছি উৎপাদনে খাবার হিসেবে ঘোড়ার মাংস, মধু, শুকনো ডিম, গুড় এবং পশুর রক্তের বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে। কৃত্রিম পরিবেশে লালন-পালনের পর শূককীটগুলো যখন মূককীট (পিউপা) দশায় পৌঁছায়, তখন সেগুলোকে ট্রেতে রেখে বিশেষ প্রক্রিয়ায় পূর্ণবয়স্ক মাছিতে পরিণত করা হয়।

তবে বিশেষজ্ঞরা এই অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। সম্প্রতি গুয়াতেমালা-মেক্সিকো সীমান্তে আকাশ থেকে মাছি ছিটানোর সময় একটি দুর্ঘটনায় কয়েকজন আহত হয়েছেন। তাই এবার বিশেষ ধরনের বাক্স বা ‘ক্রেট’ ব্যবহার করে সতর্কতার সঙ্গে মাছি ছড়ানোর কথা বলা হয়েছে।

পঞ্চাশের দশকে ‘হুইজ প্যাকার’ নামের বিশেষ কাগজের পাত্র ব্যবহার করে বিমান থেকে মাছি ছিটানো হয়েছিল। পুরোনো সেই প্রযুক্তির আধুনিক সংস্করণ এবার কতটা সফল হবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে মার্কিন কৃষি কর্মকর্তারা মনে করছেন, স্ক্রুওয়ার্মের আগ্রাসন ঠেকাতে এটিই সবচেয়ে কার্যকর উপায়। পরিকল্পনা সফল হলে, মাছি ব্যবহার করেই এক বড় সংকট মোকাবিলায় জয়ী হবে যুক্তরাষ্ট্র।