এন’গোলো কান্তে: রঙিন ফুটবলারের সাদাকালো জীবন

চাইলে বিলাসবহুল গাড়ি কিনতে পারেন। করতে পারেন উচ্চাভিলাসী জীবন যাপন। কিন্তু এন’গোলো কান্তে স্রোতের বিপরীতে চলা মানুষ। বিশ্বজুড়ে গ্ল্যামার আর ক্যামেরার ঝলকানি এড়িয়ে চলাই তার স্বাভব। মাঠে ঘাম ঝরানো ছাড়া অন্যকিছুতেই বিশ্বাসী নন বিশ্বকাপজয়ী এই তারকা। কান্তে চলেন নিজের মতোই।

কান্তের জন্ম ১৯৯১ সালের মার্চে; মালিয়ান অভিবাসী পরিবারে। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের কাছে ছোট শহর সার্সেন থেকেই বেড়ে ওঠা তার। অভাবের মধ্যেও বাবা-মা কান্তেকে স্কুলে পাঠিয়েছিলেন। তখন থেকেই তিনি বুঝে গিয়েছিলেন পরিবার মানেই দায়িত্ব। যা এখন বছরের পর বছর ধরে পালন করেন যাচ্ছেন এই তারকা।

শৈশবেই জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খান কান্তে। ১১ বছর বয়সে হারান বাবাকে। ওই ছোট্ট কাঁধে তুলে নেন বড় দায়িত্ব। শিশু বয়সে জীবনের কঠিন বোঝা বইতে শুরু করেন। রাস্তার আবর্জনা কুড়িয়ে বিক্রি করা এবং পাড়ার ফুটবল মাঠে দিনরাত খেলা তার জীবনের রুটিন হয়ে উঠেছিল। ফুটবল এবং পরিবার দুটোর প্রতিই সমান নিবেদন ছিল কান্তের।

পুরাতন মিনি কুপার চালান বিশ্বকাপজয়ী ফরাসি ফুটবলার এন’গোলো কান্তে। ছবি: এক্স

গড়নে কিছুটা ছোট হওয়ায় প্রথমে কান্তেকে তেমন একটা গুরুত্ব দিতেন না কেউ। কিন্তু ফুটবল দুনিয়াকে নজরে আনতে বাধ্য করেন তিনি। পুরো দেড় ঘণ্টা দৌড়ানোর সামর্থ্য আছে তার। রক্ষণদুর্গে তিনি প্রায় দুর্ভেদ্যে প্রাচীরের মতোই। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার কান্তে। রক্ষণ থেকে মধ্যমাঠ, সেখান থেকে আক্রমণ ভাগ, বলের সুর তুলে দিতে যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন তিনি।

২০১২ সালে ফ্রান্সের অখ্যাত ক্লাব বোলোনের জার্সিতে পেশাদার ফুটবলার হিসেবে অভিষেক হয় কান্তের । এরপর সুযোগ পান দেশটির আরেক ক্লাব সিয়ানে। কিন্তু কান্তে সত্যিকারের কান্তে হয়ে ওঠেন ইংলিশ ফুটবলে গিয়ে। ২০১৫-১৬ মৌসুমে খেলেন লেস্টার সিটিতে। ওই মৌসুমেই ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ জিতে ফুটবল দুনিয়াকে চমকে দেয় ক্লাবটি।

যা ক্লাব ফুটবলের ইতিহাসের অন্যতম সেরা রূপকথার গল্প। যেটির নেপথ্য নায়ক ক্লদিও রানিয়েরি। লেস্টার সিটির ওই রূপকথার যাত্রার অন্যতম সারথি ছিলেন কান্তে। পরের মৌসুমেই তাকে কিনে নেয় চেলসি। সেখানেও কান্তে দেখালেন নিজের ক্লাস। ২০১৭ সালে চেলসির ইংলিশ লিগ জয়ে বড় ভূমিকা রাখেন তিনি। পরের বছর মিলল আরও বড় পুরস্কার।

২০১৮ সালে রাশিয়া বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন করেন ফ্রান্সকে। সবখানেই কান্তে ছিলেন নীরব নায়ক। ফুটবলের এসব সাফল্য কান্তের জীবনকে করতে পারতো রঙিন। কিন্তু তিনি নিজেই বেছে নেন সাদাকালো জীবন। মাঠের চেয়ে কান্তের বাইরের জীবন নিয়েই তাই বেশি আলোচনা হয় সারা পৃথিবীতে। কান্তে পুরাতন একটি মিনি কুপার চালাতেন!

বিএমডব্লিউ, রোলস রয়েস, ল্যাম্বরগিনির মতো বিলাসবাহুল গাড়ি কেনার সামর্থ্য আছে কান্তের। কিন্তু সেসবের ধারেকাছেও যান না তিনি। সাধারণ মানুষের মতোই চলাফেরা করতে চান ৩৪ বছর বয়সী এই ফুটবলার। দান করেন অসহায়দের। বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠান পায় কান্তের অনুদান। সামাজিক দায়বদ্ধতা তুলে নিয়েছেন কাঁধে। মানুষের কল্যাণে অনেক কিছুই তৈরি করেছেন কান্তে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ফুটবল একাডেমি, মসজিদ নির্মাণ করেছেন কান্তে। ম্যাচ শেষে ক্লাব কিংবা দলের সঙ্গে ডিনারে না গিয়ে মসজিদে গিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে খেতে বসে পড়েন কান্তে। আসলে উচ্চাভিলাসী জীবনের চেয়ে সাদামাটা ছন্দটাই তার শক্তি। তিনি প্রমাণ করেছেন গ্ল্যামারের বাইরে গিয়েও একজন ফুটবলার কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসার পাত্র হতে পারেন।

কান্তের জীবন আমাদের শেখায়, সহজ-সরল থাকাই সবচেয়ে বড় শক্তি। কান্তে হয়তো ‘পোস্টার বয়’ নন। একজন মাটির মানুষ। বিনয়ের অবতার। তিনি আমাদের শেখান বিনয়। একজন সফল ফুটবলার হিসেবে তার পদাঙ্ক অনুকরণীয়, এক অদম্য লড়াই আর বিনয়ের প্রতীক তিনি। মাঠের বাইরে ভীষণ অনুকরণীয় একজন মানুষ। এ রকম গল্পই তো ফুটবলকে মানুষের খেলা করে রাখে।

ইউরোপ ছেড়ে ২০২৩ সালের মাঝামাঝিতে কান্তে যোগ দেন সৌদি আরবের ক্লাব ফুটবলে। নাম লেখান মধ্যপ্রাচ্যের ক্লাব আল ইত্তিহাদে। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন সৌদিয়ান ক্লাবে খেলে আর ফ্রান্স জাতীয় দলে ফিরতে পারবেন না। কিন্তু ফ্রান্স ফুটবলকে আরও কিছু দেওয়ার বাকি ছিল তার। এ জন্যই তাকে ডেকে নেন ফ্রান্সের কোচ।

সবুজ মাঠে কান্তেকে বলা হয় নীরব ঘাতক। চুপিসারে বল কেড়ে নেওয়া, রক্ষণের বড় একটা অংশ সামাল দেওয়া, সতীর্থদের ভরসা জোগাতে পারা— সবমিলিয়ে কান্তে অনেক কোচেরই স্বপ্নের খেলোয়াড়। তিনি যে দলেই খেলেছেন, সাফল্য এসেছে। শুধু একজন ফুটবলার হিসেবে নন, মানুষ হিসেবেও সফল কান্তে। আর তা না হলে কি কোটি কোটি মানুষের এমন নিখাদ ভালোবাসা পাওয়া যায়!

তাই তো অনেকেই বলে থাকেন, ‘কান্তেকে হাসি-খুশি দেখতে সবসময়ই ভালো লাগে!’