শুল্কের চাপে চাপা পড়ছে চীনের হুমকি! এশিয়ায় নতুন বাস্তবতার মুখে যুক্তরাষ্ট্র

ইউক্রেনে রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান হামলা এবং শান্তি চুক্তি নিয়ে রুশ প্রেসিডেন্টের আন্তরিকতা নিয়ে সৃষ্ট উত্তেজনার মধ্যেই মালয়েশিয়ায় বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন মার্কিন ও রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বৃহস্পতিবার দুই দেশের শীর্ষ কূটনীতিকদের মধ্যে এই উত্তপ্ত আলোচনা অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ কুয়ালালামপুরে আসিয়ান আঞ্চলিক ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনে মিলিত হবেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১০টি দেশের জোট আসিয়ানের এই আয়োজনে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার রাশিয়া, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রও অংশগ্রহণ করছে।

এই বৈঠকটি এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে পুনরায় প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্র সরবরাহ শুরু করেছে। অভ্যন্তরীণ অস্ত্রের মজুদ পর্যালোচনার কথা বলে কিছুদিন এই সরবরাহ বন্ধ রেখেছিল পেন্টাগন, যা মস্কোকে বেশ আনন্দিত করেছিল।

ইউক্রেনে রাশিয়ার বিমান হামলা বেড়ে যাওয়ায় এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কর্মকাণ্ডে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়ায় পুনরায় অস্ত্র সরবরাহ শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অস্ত্র সরবরাহের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, “পুতিন মানুষের সঙ্গে ঠিক আচরণ করছেন না। এতে বহু মানুষ নিহত হচ্ছে। তাই আমরা ইউক্রেনকে কিছু প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্র পাঠাচ্ছি এবং আমি তা অনুমোদন করেছি।”

কূটনৈতিক উদ্যোগের ওপর শুল্কের ছায়া

মার্কো রুবিওর এই কূটনৈতিক উদ্যোগ মার্কিন শুল্ক হুমকির কারণে ম্লান হয়ে যেতে পারে। পহেলা আগস্ট থেকে বহু দেশের ওপর নতুন শুল্ক আরোপের কথা রয়েছে। মার্কিন এই শীর্ষ কূটনীতিকের প্রথম এশিয়া সফরে এটি একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে, বিশেষ করে যখন যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবেলায় সম্পর্ক জোরদার করতে চাইছে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সোমবার ও বুধবার বেশ কয়েকটি দেশকে জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি না করলে তাদের উচ্চ শুল্কারোপের সম্মুখীন হতে হবে। এই দেশগুলোর মধ্যে আসিয়ানের ১০ সদস্যের আটটি দেশই রয়েছে।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই বৈঠকে রুবিওর আলোচনার মূল বিষয় শুল্ক বা বাণিজ্য থাকবে না। ট্রাম্পের রিপাবলিকান প্রশাসন চাইছে, বৈঠকে দক্ষিণ চীন সাগরে সামুদ্রিক নিরাপত্তা, যেখানে চীন তার ছোট প্রতিবেশীদের প্রতি ক্রমশ আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে, এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ দমনের মতো বিষয়গুলো প্রাধান্য পাক।

তবে রুবিওর পক্ষে শুল্কের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া কঠিন হতে পারে। এই বিষয়টি এশিয়ার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং আসিয়ানের বেশিরভাগ সদস্যকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। ট্রাম্পের ঘোষণা অনুযায়ী, চুক্তি না হলে এই দেশগুলোকে ২৫ শতাংশ শুল্কের মুখোমুখি হতে হবে।

মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম সতর্ক করে বলেছেন, বিশ্ব বাণিজ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বুধবার আসিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এক বৈঠকে তিনি আঞ্চলিক বাণিজ্য শক্তিশালীকরণ এবং বহিশক্তির ওপর নির্ভরতা কমানোর জন্য জোটের প্রতি আহ্বান জানান।

ওবামা প্রশাসনের সাবেক কর্মকর্তা এবং এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের সহ-সভাপতি ড্যানি রাসেল বলেন, “চীনের হুমকি নিয়ে রুবিওর বক্তব্য সেই সব কর্মকর্তাদের কাছে গুরুত্ব পাবে না, যাদের শিল্প ৩০-৪০ শতাংশ শুল্কের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।” রাসেল আরও বলেন, “আনোয়ার ইব্রাহিম যখন বলেছেন ‘আসিয়ান একটি ঐক্যবদ্ধ জোট হিসেবে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে’, তখন তিনি চীনের জবরদস্তির কথা বলেননি, বরং মার্কিন শুল্কের কথাই বুঝিয়েছেন।”

আসিয়ানের ১০ সদস্যের মধ্যে প্রায় সবকটি দেশের ওপরই ট্রাম্প শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন। এর আওতায় দেশগুলোর ইলেকট্রনিক্স এবং বৈদ্যুতিক পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক বসতে পারে। মালয়েশিয়ার বাণিজ্যমন্ত্রী জাফরুল আজিজ বুধবার জানান, তার দেশ শুল্ক আলোচনা পুনরায় শুরু করতে প্রস্তুত, তবে সরকারি ক্রয়, হালাল সনদ, চিকিৎসা মান এবং ডিজিটাল কর সংক্রান্ত মার্কিন অনুরোধের বিষয়ে কোনো ছাড় দেবে না।

বুধবার ট্রাম্প আসিয়ানের আরও দুটি সদস্য দেশ ব্রুনাই এবং ফিলিপাইনের জন্য শুল্কের ঘোষণা দেন, যাদের আমদানির ওপর যথাক্রমে ২৫ শতাংশ ও ২০ শতাংশ কর আরোপ করা হবে। এ সপ্তাহে কম্বোডিয়া (৩৬%), ইন্দোনেশিয়া (৩২%), লাওস (৪০%), মালয়েশিয়া (২৫%), মিয়ানমার (৪০%) এবং থাইল্যান্ডের (৩৬%) ওপর শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়া হয়। সম্প্রতি ভিয়েতনাম ২০ শতাংশ শুল্কের একটি বাণিজ্য চুক্তিতে সম্মত হয়েছে, আর সিঙ্গাপুরের ওপর এপ্রিলে আরোপিত ১০ শতাংশ শুল্ক এখনও বহাল আছে।

কুয়ালালামপুরে প্রায় ৩৬ ঘণ্টার সংক্ষিপ্ত সফরে রুবিওর সঙ্গে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই-এর মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ড্যানি রাসেলের মতে, চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এই ধরনের বৈঠকে একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি এবং ‘আসিয়ানের রীতিনীতিতে পারদর্শী’। অন্যদিকে, রুবিও একজন ‘নবাগত’, যিনি এক সন্দিহান শ্রোতাদের কাছে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বার্তা বিক্রি করার চেষ্টা করছেন।

বাণিজ্য, মানবাধিকার, দক্ষিণ চীন সাগরের সামরিকীকরণ এবং ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়াকে চীনের সমর্থনসহ বিভিন্ন বিষয়ে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ধরনের বিরোধ রয়েছে। মার্কিন কর্মকর্তারা অভিযোগ করে আসছেন যে, চীন রাশিয়ার সামরিক শিল্প খাতকে পুনর্গঠন ও সরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা করছে, যা দিয়ে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর জন্য অতিরিক্ত অস্ত্র তৈরি করতে পারছে।