আপনি পড়ছেন

জীবনের প্রায় অর্ধেকটা সময় রাজনীতি আর জনসেবায় কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি। বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই, ২০২৫) শতবর্ষে পা রাখা মালয়েশিয়ার এই কিংবদন্তি নেতার নাম মাহাথির মোহাম্মদ। জীবনের একশ বছর পূর্ণ করার এই বিরল মুহূর্তে তুরস্কের সংবাদ সংস্থা আনাদোলুকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি সমকালীন বিশ্ব, গণতন্ত্র এবং পশ্চিমা সভ্যতার ভূমিকা নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছেন। তার মতে, বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে এবং পশ্চিমা সভ্যতার পতন ঘটেছে।

মাহাথির মোহাম্মদ

মালয়েশিয়ার দুইবারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মাহাথির মোহাম্মদ গণতন্ত্রের অন্যতম বড় সুবিধাভোগী হলেও এর কার্যকারিতা নিয়ে তার মতামত অত্যন্ত কঠোর এবং সংশয়পূর্ণ। তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্র মানুষের সৃষ্টি এবং এটি নিখুঁত নয়। এর থেকে সেরাটা পেতে হলে আপনাকে এর ব্যবহার জানতে হবে।’

নিজের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বহুদলীয় ব্যবস্থার সমালোচনা করে একটি সরল পদ্ধতির পক্ষে মত দেন। মাহাথির বলেন, ‘গণতন্ত্রে কেবল দুটি দল থাকা উচিত। যখন দুটি দল একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, তখন যেকোনো একটি জয়ী হতে পারে এবং এর মাধ্যমে একটি শক্তিশালী সরকার গঠন করা সম্ভব।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘কিন্তু যেহেতু সবাই নেতা হতে চায় এবং মানুষ ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে যায়, তারা সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে না। তাই অনেক ক্ষেত্রেই গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে।’

বর্তমান বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায়, মাহাথির গাজায় ইসরায়েলের চালানো গণহত্যাকে একটি ভয়াবহ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বৈশ্বিক শক্তি, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের নৈতিক পতনের কঠোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘সাধারণত এমন অবিচার, যেমন গাজায় গণহত্যা দেখলে তা থামানোর জন্য আপনার কিছু করা উচিত। কিন্তু এখানে আমরা তা থামাতে পারছি না, কারণ এই গণহত্যার পেছনে রয়েছে আমেরিকা—একটি পরাশক্তি।’

তিনি আরও বলেন, ‘যে কেউ এই গণহত্যা প্রতিরোধের চেষ্টা করলে আমেরিকা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেয়। সুতরাং, এটি পশ্চিমা সভ্যতার একটি পরিপূর্ণ পতন।’ মাহাথির আক্ষেপ করে বলেন, পশ্চিমা বিশ্ব তাদের ‘উত্তম ও নৈতিক মূল্যবোধ’ হারিয়েছে এবং তাদের কর্মকাণ্ড এমন পর্যায়ে নেমে গেছে যে সেগুলোকে ‘অসভ্য’ হিসেবেই বিবেচনা করা যায়। তিনি বলেন, ‘আমাদের আধুনিক সভ্যতা ব্যর্থ হয়েছে। আমি বলব, আমরা সভ্যতার মূল্যবোধের দিক থেকে আদিম যুগে ফিরে গেছি।’

গাজায় চলমান আক্রমণে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি মন্তব্য করেন যে ওয়াশিংটন বিশ্বনেতা হিসেবে তার ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ হারিয়েছে। মাহাথির দৃঢ়ভাবে বলেন, ‘আজ আমরা জানি যে যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার, এমনকি মানুষের জীবন নিয়েও ভাবে না এবং তারা বাকি বিশ্বের জন্য কোনো আদর্শ নয়।’

রাজনৈতিক যাত্রা ও দৃষ্টিভঙ্গি

মাহাথির মোহাম্মদের জন্ম ১৯২৫ সালের ১০ জুলাই, তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনাধীন কেদাহ রাজ্যের আলোর সেতারে। পেশায় চিকিৎসক হলেও মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনে (ইউএমএনও) যোগ দিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। সাত বছর চিকিৎসা পেশায় থাকার পর, ১৯৬৪ সালে তিনি মালয়েশিয়ার সংসদে নির্বাচিত হন। এরপর বহু বাধা সত্ত্বেও তাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি।

মালয়েশিয়ার সর্বোচ্চ সম্মানসূচক ‘তুন’ উপাধিতে ভূষিত মাহাথির ১৯৮১ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন এবং প্রায় ২২ বছর দায়িত্ব পালন করেন। তার শাসনামলে মালয়েশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের আলোকবর্তিকায় পরিণত হয়। ২০১৮ সালে তিনি আশ্চর্যজনকভাবে ক্ষমতায় ফিরে এলেও দুই বছর পর মিত্রদের সমর্থন হারিয়ে পদত্যাগ করেন।

নিজের কার্যালয়ে বসে আর্কাইভ গোছানোর ফাঁকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি তারুণ্যের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমরা স্বাধীন হওয়ার পর আমার কিছু ধারণা ছিল। আমি সেই ধারণাগুলো প্রয়োগ করেছি এবং সৌভাগ্যবশত, কিছু ফলও পেয়েছি। আমরা আমাদের দেশকে সমৃদ্ধ করতে পেরেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা কখনো ভাবিনি, কিন্তু ঘটনাচক্রে আমি সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় ছিলাম।’

দীর্ঘায়ুর রহস্য

বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত তার অক্লান্ত কর্মনিষ্ঠা এবং দীর্ঘজীবনের রহস্য সম্পর্কে জানতে চাইলে মাহাথির বলেন, ‘আমি সত্যিই জানি না। আমার ধারণা, আপনি যদি মারাত্মক কোনো রোগে আক্রান্ত না হন, তবে দীর্ঘকাল বেঁচে থাকতে পারবেন।’ তিনি অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ না করার পরামর্শ দেন।

তিনি আরও বলেন, ‘আমি কিছুটা শরীরচর্চা করি... তবে আমি আমার মন ও মস্তিষ্ককে সক্রিয় রাখি—পড়া, লেখা, কথা বলা, আলোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে। আমি বিশ্বাস করি, ভালোভাবে কাজ চালিয়ে যেতে হলে শরীর ও মন দুটোকেই সক্রিয় রাখতে হবে।’

এই দীর্ঘ যাত্রায় তার স্ত্রী ৯৮ বছর বয়সী সিতি হাসমাহর অবিচল সমর্থনের কথাও তিনি উল্লেখ করেন। মাহাথির বলেন, ‘আমার স্ত্রী সবসময় আমার সঙ্গে ছিলেন। তিনি শুধু একজন স্ত্রীই নন, একজন সঙ্গী এবং বন্ধুও।’

মালয়েশিয়া ও মুসলিম বিশ্বের ভবিষ্যৎ

মালয়েশিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতি অবশ্যই ‘সু-পরিচালিত’ এবং রাজনৈতিকভাবে ‘স্থিতিশীল’ হতে হবে। মুসলিম বিশ্বের অনৈক্য নিয়ে আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত, ওআইসি (ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা) কাজ করতে পারেনি কারণ সংস্থাটি সর্বসম্মতির ওপর নির্ভর করে। কোনো একটি দেশ দ্বিমত পোষণ করলেই আর কিছু করা যায় না। এ কারণেই ইসরায়েলের মতো বিষয়েও ওআইসি কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি।’

নিজের কীর্তি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি দেশের জন্য কাজ করে অত্যন্ত সন্তুষ্ট। আমি কী করেছি, সে বিষয়ে অন্যরা কী ভাববে, তা তাদের ওপরই ছেড়ে দিলাম।’

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর

Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.

Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.