সাদিও মানে: আমার কিছু নেই, যা কিছু গ্রামের মানুষের
- Details
- by প্রিন্স রাসেল
আফ্রিকা মহাদেশের ছোট্ট গ্রাম বাম্বালি। এখান থেকেই তার উত্থান। জন্ম ১৯৯২ সালে। তখন প্রযুক্তির প্রতিফলন সেখানে ঘটেনি। অমন দুর্গম জায়গাতে বসে ছোট্ট ছেলেটি স্বপ্ন দেখছিলেন, ইউরোপ কাঁপানোর। সেই শিশুটির নাম সাদিও মানে। যার শৈশব কেটেছে দারিদ্র্য আর সীমাহীন চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে।

পরিবার থেকে সমর্থন মেলেনি। জীবন যেখানে থমকে যাচ্ছিল তখন মানের স্বপ্ন দেখাটা ছিল শুধুই বিলাসিতা। কিন্তু হাল ছাড়েননি তিনি। পাড়ার মাঠে, খালি পায়ে, ছেঁড়া বল নিয়ে স্বপ্নের বীজ বুনতে থাকেন মানে। ১৫ বছর বয়সে পরিবারকে না জানিয়ে পাহাড়সম আশা নিয়ে মানে চলে আসেন সেনেগালের রাজধানী ডাকারে।
সেখানেই ভর্তি হন স্থানীয় এক ফুটবল একাডেমি ‘জেনারেশন ফুট‘এ। এখানেই ফুটবলে হাতেখড়ি। সেখানেই আফ্রিকান কিশোর নজরে আসেন ইউরোপিয়ান স্কাউটদের। যা ঘুরিয়ে দেয় মানের জীবনের মোড়। এরপর শুধুই এগিয়ে চলা। ২০১১ সালে নাম লেখান ফরাসি ক্লাব মেত্জে। শুরু হয় পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ার।
সেখানে বেশিদিন থাকতে হয়নি। এক বছর পরই অস্ট্রিয়ান ক্লাব রেড বুল সালজবুর্গে যোগ দেন মানে। সেখানে কাটে তিন বছর। ২০১৪ সালে মানে পাড়ি জমান ইংলিশ ফুটবলে। নাম লেখান সাউদ্যাম্পটনে। এই দুটি ক্লাবের হয়েই ফুটবল বিশ্বকে নিজের আগমনীর চূড়ান্ত বার্তা দিয়ে দেন মানে।
এই প্রতিভা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেনি সাউদ্যাম্পটনও। মানের গতি, স্কিল এবং গোল করার সামর্থ্য চোখে পড়ে লিভারপুল কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপের। ২০১৬ সালে মার্সিসাইডের ক্লাবটিতে তাকে নিয়ে আসেন জার্মান কোচ। এরপর বাকিটা ইতিহাস। মানে হয়ে ওঠেন লিভারপুলের ইতিহাস ও একাদশের অপরিহার্য অংশ।
রবার্তো ফিরমিনো ও মোহাম্মদ সালাহর সঙ্গে মানে গড়ে তোলেন বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী আক্রমণভাগ। এই ত্রয়ী লিভারপুলকে এনে দেন সম্ভাব্য সব শিরোপা। ইংলিশ এই ক্লাবটিতে ছয় বছর ছিলেন মানে। ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে লিভারপুল ছেড়ে বায়ার্ন মিউনিখে যোগ দেন আফ্রিকান এই তারকা।
সেখানে অবশ্য এক মৌসুম ছিলেন তিনি। ২০২৩ সালে সেনেগালিজ ফরওয়ার্ড যোগ দেন সৌদি আরবের ক্লাব আল নাসেরে। তার ক্যারিয়ার এখন সায়াহ্নে। সেরা সময়ে শুধু ক্লাব ফুটবল নয়, আন্তর্জাতিক ফুটবলেও আগুন ঝরিয়েছেন মানে। ২০১২ সালে সেনেগাল অনূর্ধ্ব-২৩ ফুটবল দলের হয়ে খেলেন অলিম্পিক।
একই বছর জাতীয় দলে অভিষেক হয় মানের। সেনেগালের ফুটবল ইতিহাসে তিনিই এখন সর্বোচ্চ গোলাদাতা। দেশের হয়ে ১১৩ ম্যাচে ৪৫ গোল করেছেন ৩৩ বছর বয়সী এই তারকা। তার দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের সুবাদে তিনবার আফ্রিকান নেশনস কাপের ফাইনাল খেলেছে সেনেগাল।
২০২১ সালে প্রথমবারের মতো সেনেগাল জেতে মহাদেশীয় শিরোপা। পরের বছর দ্বিতীয়বারের মতো আফ্রিকান বর্ষসেরা ফুটবলারের খেতাব পান মানে। এ ছাড়া অসংখ্য ব্যক্তিগত ট্রফি জেতেন তিনি। আর দলীয়ভাবে ১১টি শিরোপার স্বাদ পান এই ফরওয়ার্ড। এসব সাফল্যের অন্যতম রূপকার মানে নিজেই।
২০০২ সালে প্রথমবার ফিফা বিশ্বকাপ খেলে সেনেগাল। সেবার সবাইকে চমকে দিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে গিয়েছিল আফ্রিকার দেশটি। পরের তিনটি বিশ্বকাপে দর্শক সারিতে থাকতে হয় তাদের। মানের নেতৃত্ব ও দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের ওপর দাঁড়িয়ে ২০১৮ বিশ্বকাপে ফেরে সেনেগাল। ২০২২ বিশ্বকাপও খেলে তারা।
ক্যারিয়ারজুড়ে সাফল্য পেয়েছেন মানে। একজন আদর্শ ফরওয়ার্ড হিসেবে প্রয়োজনীয় সব গুণই ছিল তার। মাঠে যেমন আলোচিত তিনি, বাইরে তাকে নিয়ে আলোচনা হয় আরও বেশি। ইউরোপিয়ান ফুটবলের অর্থের ঝনঝনানি এবং মুহুর্মুহু ক্যামেরার ফোকাসে কখনও ভ্রুক্ষেপ ছিল না তার। মানের পা সবসময়ই ছিল মাটিতে।
কোটি কোটি ডলার আয় করলেও মানে ভুলে যাননি নিজের শেকড়। গ্রামের বহু মানুষকে ঘর বানিয়ে দিয়েছেন। সেনেগালে প্রতিষ্ঠা করেছেন মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল, হাসপাতাল, স্টেডিয়াম, ফুটবল একাডেমি এবং সামাজিক অনেক প্রতিষ্ঠান। এমনকি গ্রামের অসহায় প্রতিটি পরিবারের জন্য মাসিক ভাতা পর্যন্ত ব্যবস্থা করেছেন মানে।
এমন শত শত উদ্যোগে মানে বুঝিয়ে দিয়েছেন মাটির মানুষ তিনি। বিভিন্ন সময় শোনা যায়, সেনেগাল অধিনায়ক তার আয়কৃত অর্থের ১০ ভাগ শুধু নিজের জন্য রাখেন। বাকি অর্থ মানুষের কল্যাণে ব্যয় করেন। অপ্রয়োজনে অর্থ খরচ করেন না তিনি। বিশ্বজুড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তার ব্যবহৃত ভাঙা আই ফোনের ছবিও ছড়িয়েছিল!
এক সাক্ষাৎকারে মানে বলেছিলেন, ‘বিলাসবহুল গাড়ি-বাড়ি, বিমান, স্বর্ণালঙ্কার, হীরা এসব আমি কেন করব? এটা ইসলামের শিক্ষা নয়। এসবের চেয়ে অসহায় মানুষকে সহায়তা করা আমার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ ইউরোপিয়ান সংস্কৃতিতে দীর্ঘ সময় থাকার পরও ধর্মের প্রতি অটল ছিলেন মানে। প্রায়শই ম্যাচ শেষে মাঠেই প্রার্থনা করতে দেখা যায় তাকে।
গোলের পর সবুজ ঘাসে সেজদা দিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে মানেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশে দেখা গেছে অসংখ্যবার। এমনকি রোজা রেখেও ফুটবল খেলেছেন তিনি। ইসলাম ধর্মের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস তাকে মাটির মানুষ হতে সাহায্য করেছে। নিজের জন্য কখনোই সেভাবে ভাবেননি মানে। নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন মানুষের জন্য।
সংবাদমাধ্যমে তিনি বলেছিলেন, ‘যদি তুমি ভালো থাকো, অন্যকেও ভালো রাখার চেষ্টা করো। এটাই তো প্রকৃত সুখ। আমার নিজের বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি নেই। যা আছে সবকিছুই গ্রামের মানুষের। আমি যত বড় হই না কেন, আমি সাদিও-ই (মানে) থাকব। গ্রামের সেই ছেলেই থাকব, যে কলার খোসা দিয়ে ফুটবল বানিয়ে খেলতো।’
পুরো জীবনকে মানে একটা বাক্যেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, ‘(ইসলাম) ধর্মই আমাকে মানুষ হিসেবে বাঁচতে শিখিয়েছে। মানুষের পাশে থাকতে শিখিয়েছে।’ মানের এই দর্শন মানুষের মতো মানুষ হয়ে ওঠার জন্য বড় উদাহরণ। তিনি শেখান গোল করা বা ট্রফি জেতা নয়, শিকড়কে ভালোবাসা আর অন্যের জীবন বদলে দেওয়াই সত্যিকারের সফলতা।
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.