আপনি পড়ছেন

চিত্রকলার রঙে জীবনের গল্প আর স্মৃতির ক্যানভাস ফুটিয়ে তোলার দিনগুলো এখন অতীত। বেঁচে থাকার তাগিদে, সন্তানদের মুখে এক টুকরো রুটি তুলে দিতে নিজের হাতে গড়া শিল্পকর্মই এখন পোড়াচ্ছেন ফিলিস্তিনি চিত্রশিল্পী ও আর্ট থেরাপি গবেষক তাহা হুসেইন আবু ঘালি। ইসরায়েলি অবরোধে গাজায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় উপকরণের তীব্র সংকটে জীবন যখন দুর্বিষহ, তখন শিল্পই হয়ে উঠেছে তার টিকে থাকার একমাত্র জ্বালানি।

তাহা হুসেইন আবু ঘালি নিজের চিত্রকর্ম ভেঙে খাবার রান্না করছেন

সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ৪৩ বছর বয়সী তাহা তার আঁকা ছবির কাঠের ফ্রেমগুলো ভেঙে উনুনে দিচ্ছেন। সন্তানদের জন্য রান্না করতে নিজের সৃষ্টিকেই তিনি সঁপে দিচ্ছেন আগুনে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আল্লাহ সাক্ষী, এগুলো ছিল আমার সবচেয়ে সুন্দর ছবি। এগুলো ছিল আমার হৃদয়ের সঙ্গীত। এখন আমি সেগুলো ভেঙে পুড়িয়ে ফেলছি। কারণ শিল্প এখন রুটি হয়ে গেছে।’

ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা সেই ভিডিওতে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বুকের ভেতর ব্যথা নিয়ে আমাদের ছবিগুলো পুড়িয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছি। আমাদের কাছে কোনো জ্বালানি নেই, বিদ্যুৎ নেই, গ্যাস নেই, কিছুই নেই। ভাগ্য ভালো হলে হয়তো কিছু আটা বা ডাল জোটে, কিন্তু সেগুলো রান্না করার মতো কিছুই থাকে না। তাই ছবি থেকেই কাঠ জোগাড় করতে হয়। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।’

তার এই ভিডিও মুহূর্তেই বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। শিল্পী, সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীরা তার এই মর্মান্তিক গল্পটি ছড়িয়ে দেন। তবে তাহা স্পষ্ট করে দিয়েছেন, ‘এটি করুণা চাওয়ার কোনো চেষ্টা নয়, বরং বর্তমান বাস্তবতার এক নির্মম আয়না।’

টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সত্যি বলতে, আমরা এখন মৃত্যু থেকে এক ধাপ দূরে দাঁড়িয়ে আছি। বন্ধুদের সাহায্যে কোনোমতে টিকে আছি। কিন্তু মানবিক পরিস্থিতি সত্যিই ভয়াবহ। আমরা গণমৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে।’

তিন ছেলে ও যমজ দুই কন্যার জনক তাহা তার পরিবার নিয়ে বর্তমানে গাজার খান ইউনিসের পশ্চিমে আসদা শহরের একটি তাঁবুতে বসবাস করছেন। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত তাদের ১১ বার স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা আল-নাসর এলাকায় থাকতাম। এরপর রাফাহ, আল-আকসা বিশ্ববিদ্যালয়, হামাদ শহর—এভাবে ১১ বার স্থান বদল করেছি।’

প্রায় ২০টি শিল্পকর্ম কেন পুড়িয়ে ফেললেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ‘এক কিলোগ্রাম কাঠের দাম আট শেকেল। শুধু রুটি বানানোর জন্যই আমাদের দিনে অন্তত তিন কিলোগ্রাম কাঠের প্রয়োজন হয়। ঘরের দরজা, আলমারি, শিশুদের পড়ার টেবিল পুড়িয়ে ফেলার পর আর কিছুই বাকি ছিল না। তাই ছবির ফ্রেমই ছিল শেষ ভরসা।’

শিল্পী হিসেবে তাহা হুসেইনের যাত্রা শুরু হয়েছিল শৈশবেই। ফিগারেটিভ স্যুরিয়ালিজমের সঙ্গে অ্যাবস্ট্রাক্ট ও কিউবিজমের মিশ্রণে তিনি নিজস্ব ধারার সৃষ্টি করেছেন। শিল্পকলা শিক্ষা ও মানবিক বিদ্যায় ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি মানসিক স্বাস্থ্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। আল-নাসর মডেল স্কুলে শিল্প, কারুশিল্প ও আরবি হস্তলিপি শেখানোর পাশাপাশি যুদ্ধের মাঝেও তিনি আর্ট থেরাপি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

গাজায় তার স্টুডিও এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ছবিগুলোকে বাঁচাতে তিনি সেগুলো বিভিন্ন জায়গায় রাখতেন, যেন এক জায়গায় বোমা হামলায় সব ধ্বংস না হয়ে যায়। কিন্তু গাজা যখন নিজেই জ্বলছে, তখন শিল্পীর সৌন্দর্য, স্মৃতি আর অর্থের শেষ চিহ্নটুকুও রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

কান্নাভেজা কণ্ঠে তাহা বলেন, ‘পোড়ানো—এটা কখনোই ছবিগুলোর ভাগ্য হওয়ার কথা ছিল না। আমি কখনো এগুলো বিক্রি করিনি, বন্ধু-বান্ধবসহ অনেককে উপহার দিয়েছি। কিন্তু এখন আমার সামনে আর কোনো বিকল্প নেই। রুটি বানানোর জন্য কাঠ দরকার।’

গাজার বর্তমান খাদ্য পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমাদের খাবারের তালিকায় এখন সবচেয়ে সস্তা আর সহজলভ্য জিনিস—বেগুন। ভাজা, সেদ্ধ, আধাসেদ্ধ—এসব খেতে খেতে আমরা অতিষ্ঠ। কিন্তু এর বেশি কেনার সামর্থ্য আমাদের নেই। মাঝে মাঝে ডাল, আর ভাগ্য খুব ভালো থাকলে কিছু চাল জোটে। সবজি নেই, ফল নেই। সূর্যের তাপে শিশুদের ত্বক কালো হয়ে যাচ্ছে। ক্ষুধা তাদের চেহারাটাই বদলে দিয়েছে।’

স্বগতোক্তির মতো করে তাহা হুসেইন বলেন, ‘শিল্পের এখন পরিণতি—এক টুকরো রুটি। সৌন্দর্য পুড়ছে আর শিশুরা খাচ্ছে তার ছাই।’

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর

Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.

Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.