পাকিস্তানে ‘বিশাল তেল ভাণ্ডার’: ট্রাম্পের ঘোষণায় তোলপাড়, বাস্তবতা কী?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি ঘোষণায় পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে নতুন আলোচনার জন্ম হয়েছে। সামাজিক মাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ তিনি জানিয়েছেন, পাকিস্তানের ‘বিশাল খনিজ তেলের ভাণ্ডার’ উন্নয়নে ইসলামাবাদের সঙ্গে একটি যুগান্তকারী চুক্তি করেছে ওয়াশিংটন। এই চুক্তির আওতায় দুটি দেশ একসঙ্গে কাজ করবে এবং এই সহযোগিতার জন্য উপযুক্ত সংস্থা বাছাইয়ের প্রক্রিয়া চলছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তবে তার মন্তব্যের সবচেয়ে আলোচিত অংশ ছিল ভারতকে নিয়ে এক খোঁচা— ‘কে জানে, হয়তো একদিন তারা ভারতকে তেল বিক্রি করবে!’

ট্রাম্পের এই আকস্মিক ঘোষণা এমন এক সময়ে এলো, যখন পাকিস্তান তীব্র জ্বালানি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশটির ‘পেট্রোলিয়াম ইনফরমেশন সার্ভিসেস’-এর তথ্যমতে, গত কয়েক মাসে স্থানীয় তেল উৎপাদন ১১ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে পাকিস্তান তার মোট চাহিদার মাত্র ১০ থেকে ১৫ শতাংশ তেল স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করতে পারে, বাকি ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশই আমদানি করতে হয়। কাদিয়ারপুর, সুই এবং উচের মতো বড় খনিগুলোতেও উৎপাদন কমে যাওয়ায় আমদানিনির্ভরতা বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে ‘বিশাল তেল ভাণ্ডারের’ ঘোষণাটি একদিকে যেমন আশা জাগাচ্ছে, তেমনই তীব্র সংশয় ও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্পের ঘোষিত ‘বিশাল ভাণ্ডার’-এর অস্তিত্ব নিয়ে যথেষ্ট ধোঁয়াশা রয়েছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ ওয়াসি খানের মতে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রমাণিত খনিজ তেলের মজুদ ছিল মাত্র দুই কোটি ৩৮ লক্ষ ব্যারেল। যদিও ইউএস এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের একটি পুরানো হিসাবে পাকিস্তানে প্রায় ৯০ কোটি ব্যারেল তেলের মজুদের কথা বলা হয়েছিল, তবে বাণিজ্যিক উত্তোলন শুরু না হওয়া পর্যন্ত এই তথ্যকে নিশ্চিত বলে ধরা যায় না। তিনি মনে করেন, বিনিয়োগ ও প্রযুক্তির অভাবেই পাকিস্তানে তেল অনুসন্ধান প্রচেষ্টা অতীতে তেমন সফল হয়নি।

বর্তমানে পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ সবচেয়ে বেশি চলছে, যেখানে ২৪৭টি কূপ রয়েছে। এছাড়া পাঞ্জাবে ৩৩টি, খাইবার পাখতুনখোয়ায় ১৫টি এবং বেলুচিস্তানে মাত্র চারটি কূপ রয়েছে। পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্সের বিশেষজ্ঞ ড. আফিয়ার মতে, নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং জটিল কর কাঠামোর কারণে খাইবার পাখতুনখোয়া ও বেলুচিস্তানের মতো সম্ভাবনাময় অঞ্চলে তেল অনুসন্ধানের কাজ ব্যাহত হচ্ছে।

এই চুক্তির ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব নিয়েও চলছে গভীর বিশ্লেষণ। পাকিস্তানে চীনের কয়েক বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ রয়েছে, বিশেষ করে জ্বালানি ও অবকাঠামো খাতে। প্রশ্ন উঠছে, আমেরিকান সংস্থাগুলোর আগমন কি পাকিস্তানে চীনের প্রভাবকে খর্ব করবে? ভূ-রাজনৈতিক অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ জাহিদ হুসেইন মনে করেন, এই ঘোষণার সরাসরি প্রভাব হয়তো চীনের প্রকল্পে পড়বে না, তবে পরোক্ষ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে, মুহাম্মদ ওয়াসি খানের মতে, এই মার্কিন সহযোগিতা চীনের জন্য হুমকি নয়, বরং পরিপূরক হতে পারে। মার্কিন বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি চীনের现有 প্রকল্পের ঘাটতি পূরণ করতে পারে, যা উভয় দেশের জন্যই লাভজনক হবে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই ঘোষণার পর ভারত ও পাকিস্তানে সামাজিক মাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তানিরা একদিকে যেমন এটিকে হাস্যকর বলে মনে করছেন, তেমনই অনেকে এটিকে ভারতের উপর চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবে দেখছেন। ফয়সাল রাঞ্ঝা নামে একজন লিখেছেন, ‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভারতের জনগণকে নিয়ে মজা করছেন। এটা মোদিজির (ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি) কাছে বড় অপমান।’

অন্যদিকে, ভারতের প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব কানওয়াল সিবাল এই ঘোষণায় অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘পাকিস্তান একদিন ভারতের কাছে তেল বিক্রি করবে বলে এই ব্যঙ্গ কেন করা হচ্ছে?’ তার মতে, এটি ট্রাম্পের মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ, যা ভারতের ওপর চাপ প্রয়োগের একটি চেষ্টা।