যুক্তরাজ্যের সংসদ সদস্য এবং সাবেক ট্রেজারি মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক দাবি করেছেন, তিনি তার খালা শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যকার রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে ‘পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার শিকার’ হয়েছেন। বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে, যাকে তিনি ‘পুরোপুরি অবাস্তব’ এবং ‘কাফকাসুলভ দুঃস্বপ্ন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

টিউলিপ সিদ্দিক

৪২ বছর বয়সী এই লেবার পার্টি নেতা একজন সাংবাদিকের মাধ্যমে জানতে পারেন যে, বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে আনুষ্ঠানিকভাবে মামলা করা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, তিনি বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগনি হিসেবে নিজের প্রভাব খাটিয়ে রাজধানী ঢাকার পূর্বাচলে তার মা, ভাই ও বোনের জন্য একটি জমি বরাদ্দ করিয়েছেন। এই ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে নিজের প্রথম সাক্ষাৎকারে টিউলিপ সিদ্দিক অভিযোগটিকে ‘সম্পূর্ণ হাস্যকর’ বলে উড়িয়ে দেন।

আগামী ১১ আগস্ট এই মামলায় টিউলিপসহ ২০ জনেরও বেশি অভিযুক্তের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হওয়ার দিন ধার্য করা হয়েছে। তবে তিনি কি সশরীরে বা ভিডিও সংযোগের মাধ্যমে আদালতে উপস্থিত হবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি হুগো কিথ কেসি-র কাছ থেকে আইনি পরামর্শ নিচ্ছি। আমার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, সে বিষয়ে তিনিই আমাকে পরামর্শ দেবেন।’

তিনি আরও যোগ করেন, ‘আমার কাছে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক সমন এসে পৌঁছায়নি। ভাবুন, একটি বিদেশি আদালতে আমার বিচার শুরু হতে আর মাত্র কয়েক দিন বাকি, অথচ আমি এখনো জানি না আমার বিরুদ্ধে ঠিক কী কী অভিযোগ আনা হয়েছে। মনে হচ্ছে, আমি যেন এক কাফকাসুলভ দুঃস্বপ্নে আটকা পড়েছি, যেখানে আমার বিচার হচ্ছে অথচ আমি নিজেই জানি না অভিযোগগুলো কী বা বিচারটি কীসের জন্য।’

বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রয়োজনে টিউলিপ সিদ্দিকের অনুপস্থিতিতেই বিচারকার্য চালানো হবে। যদি এই মামলায় তিনি দোষী সাব্যস্ত হন, তবে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে থাকা প্রত্যর্পণ চুক্তির বিষয়টি নতুন করে সামনে আসতে পারে। যদিও টিউলিপ সিদ্দিক বলেন, ‘কোনো প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই, আমি বিষয়টি নিজে খতিয়ে দেখেছি।’

গত বছরের জুলাই মাসের সাধারণ নির্বাচনে লেবার পার্টির জয়ের পর টিউলিপ সিদ্দিক তার রাজনৈতিক জীবনের এক দারুণ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। কিয়ার স্টারমারের অনুগত এই রাজনীতিবিদকে ট্রেজারির অর্থনৈতিক সচিব ও সিটি মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমি কাজটি খুব ভালোবাসতাম এবং এতে আমি দক্ষও ছিলাম।’

কিন্তু এর কিছুদিন পরেই ঢাকা থেকে পাঁচ হাজার মাইল দূরে, তার খালা শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে। বিক্ষোভকারীদের ভাষায়, একটি ‘ক্রমশ স্বৈরাচারী ও নিষ্ঠুর’ প্রশাসনের বিরুদ্ধে শত শত, এমনকি হাজারো মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদের পর শেখ হাসিনা ও তার বোন (টিউলিপের মা) শেখ রেহানা একটি সামরিক হেলিকপ্টারে করে ভারতে আশ্রয় নেন।

টিউলিপ স্বীকার করেন, সেই সময়টা ছিল ভীতিকর। তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করেন, যেখানে তার নানা, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করা হয়েছিল এবং তার স্বামী, সন্তান ও বোন ছাড়া শেখ হাসিনার পরিবারের বাকি সবাই নিহত হয়েছিলেন।

টিউলিপ বলেন, ‘আমি এখানে আমার খালার পক্ষ সমর্থনে আসিনি। আমি জানি, তাঁর শাসনামলের সমাপ্তি কীভাবে হলো, তা নিয়ে তদন্ত চলছে। আমি আন্তরিকভাবে আশা করি, বাংলাদেশের মানুষ যা জানতে চায়, সেই সত্য তাদের সামনে উন্মোচিত হবে।’

গত বছরের শেষে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ঢাকায় নতুন সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই টিউলিপ সিদ্দিকের জীবন পাল্টে যেতে শুরু করে, যাকে তিনি বাংলাদেশের ‘নোংরা রাজনীতি’ বলে অভিহিত করেন। বিভিন্ন অখ্যাত ওয়েবসাইটে তার বিরুদ্ধে রাশিয়ার একটি কোম্পানির সঙ্গে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ চুক্তি থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার আত্মসাতের অভিযোগ এনে খবর প্রকাশিত হতে থাকে। ২০১৩ সালে মস্কোতে তার খালা শেখ হাসিনা ও ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তোলা একটি ছবিও নতুন করে বিতর্কের জন্ম দেয়।

এই ছবির বিষয়ে টিউলিপ বলেন, ‘আমার খালা রাষ্ট্রীয় সফরে রাশিয়া গিয়েছিলেন, আর আমার বোন ও আমি লন্ডন থেকে সেখানে তার সঙ্গে দেখা করতে যাই। আমি কোনো রাজনৈতিক আলোচনায় যুক্ত ছিলাম না। আমরা দর্শনীয় স্থান দেখছিলাম, রেস্তোরাঁয় খাচ্ছিলাম, কেনাকাটা করছিলাম। শেষ দিনে সব রাজনীতিবিদের পরিবারকে একটি চা-চক্রে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং সেখানেই ছবিটি তোলা হয়। পুতিনের সঙ্গে আমার মাত্র দুই মিনিটের জন্য দেখা হয়েছিল।’

পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ ওঠে যে, ২০০৪ সালে খালা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘যুক্ত ব্যক্তিদের এক সহযোগী’ তাকে কিংস ক্রসে একটি ফ্ল্যাট উপহার দিয়েছিলেন। টিউলিপ জানান, ফ্ল্যাটের সাবেক মালিক ছিলেন তার ধর্মপিতা, যার সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই এবং তিনি কখনো ভোটও দেননি।

তবে সমস্যা হয়, কারণ দুই বছর আগে একটি সংবাদপত্রকে তিনি বলেছিলেন, ফ্ল্যাটটি তার বাবা-মা কিনে দিয়েছিলেন। টিউলিপের মতে, এটি ছিল তার বয়স্ক বাবা-মায়ের স্মৃতিভ্রমের কারণে হওয়া একটি ভুল।

নিজের একটি বাড়ি থাকা সত্ত্বেও তিনি কেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক আবাসন ব্যবসায়ীর বাড়িতে ভাড়া থাকেন, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। জবাবে টিউলিপ জানান, একটি নিরাপত্তা হুমকির কারণে তাকে বাড়ি বদলাতে হয়েছিল। তিনি বলেন, একজন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে আটক ব্যক্তি তার দুর্দশার জন্য টিউলিপকে দায়ী করেছিলেন। যে বছর টোরি দলের এমপি ডেভিড অ্যামেসকে হত্যা করা হয়, সে বছরই তাকে নিরাপত্তার কারণে দ্রুত বাসা বদলের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল এবং পরিচিত একজনের মাধ্যমে তিনি সেই ব্যবস্থা করেন।

এসব বিতর্কের মুখে টিউলিপ সিদ্দিক নিজেই বিষয়টি মন্ত্রিত্বের মানদণ্ড বিষয়ক স্বাধীন উপদেষ্টা স্যার লরি ম্যাগনাসের কাছে পাঠান। দুই সপ্তাহ ধরে তার আর্থিক বিষয়াদি পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনার পর ম্যাগনাস জানান, টিউলিপ মন্ত্রিত্বের আচরণবিধি লঙ্ঘন করেননি। তবে তিনি এও যোগ করেন যে, টিউলিপের পারিবারিক পরিচয় ও সরকারি পদের কারণে ‘সুনামের যে ঝুঁকি’ তৈরি হতে পারে, সে বিষয়ে তার আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল।

এই মন্তব্যটি টিউলিপকে বিরক্ত করেছে বলে মনে হয়। তিনি বলেন, ‘আমার খালা কে, তা তো আমি বদলাতে পারি না। এই মন্তব্যটি অদ্ভুত, কারণ এটা বলার মতো যে আপনার জন্ম এবং আপনি কীভাবে জন্মেছেন, সে সম্পর্কে আপনার সচেতন থাকা উচিত ছিল।’

সরকারের উপর থেকে বিতর্ক সরানোর জন্য তিনি কিয়ার স্টারমারের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও জানুয়ারিতে মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন।

টিউলিপের দাবি, ‘সত্যিটা হলো, মুহাম্মদ ইউনূস এবং আমার খালার মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারণে আমি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার শিকার। আমি এর চেয়েও বড় শক্তির বিরুদ্ধে লড়ছি। বাংলাদেশে অনেকে ভুল করেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই এবং তাদের শাস্তিও হওয়া উচিত। কিন্তু আমি তাদের মধ্যে একজন নই।’

দি গার্ডিয়ান অবলম্বনে

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর

Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.

Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.