প্রতিবেদন: ফাঁদে পড়ে রাশিয়ার যুদ্ধে বাংলাদেশিরা

রাশিয়া আইনি অভিবাসনের নামে বাংলাদেশিদের প্রতারণার মাধ্যমে ইউক্রেন যুদ্ধের সামনের সারির যোদ্ধা হিসেবে ব্যবহার করছে, এমন ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের এক নতুন প্রতিবেদনে।

‘প্রমিসেস রিটেন ইন ব্লাড: হাউ লিগ্যাল মাইগ্রেশন টার্ন্ড ইনটু ফোর্সড রিক্রুটমেন্ট ইন দ্য রাশিয়া-ইউক্রেন ওয়ার’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে বলা হয়, কমপক্ষে ১০ জন বাংলাদেশি নাগরিক ভালো চাকরি ও বেতনের প্রলোভনে রাশিয়া গিয়ে বাধ্য হয়েছেন যুদ্ধে অংশ নিতে। তাদের মধ্যে কয়েকজনের মৃত্যুর আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ব্র্যাকের তদন্তে দেখা গেছে, ভুক্তভোগীরা বৈধ ওয়ার্ক ভিসা ও চাকরির চুক্তি নিয়েই রাশিয়ায় গিয়েছিলেন। কিন্তু পৌঁছানোর পরই তাদের পাসপোর্ট ও মোবাইল ফোন বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং ‘স্বেচ্ছাসেবী সামরিক চুক্তিতে’ জোর করে সই করিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠানো হয়।

রিপোর্টে বলা হয়, অপ্রশিক্ষিত বিদেশি শ্রমিকদের যুদ্ধক্ষেত্রে ‘খরচযোগ্য জনবল’ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

ভুক্তভোগীদের একজন আফজাল হোসেন মেরাজ, গত বছরের আগস্টে ৭০ হাজার টাকার বেতনে ওয়েল্ডার হিসেবে রাশিয়া যান। এজন্য তিনি উত্তরার এক রিক্রুটিং এজেন্সিকে ৬.৫ লাখ টাকা দেন।

রাশিয়ায় গিয়ে এক দালাল তাকে ‘বেশি বেতনের সুযোগ’ দেখিয়ে সামরিক চুক্তিতে সই করান ২ লাখ ৬০ হাজার টাকার সাইনিং বোনাস ও ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকার মাসিক বেতন, আহত হলে ১৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ এবং যুদ্ধ জিতলে নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

মেরাজের বাবা আলি হোসেন বলেন, আমার ছেলে আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে জানায়, ওরা ওকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়েছে। সে বলেছিল, ‘বাবা, আমি যেকোনো সময় মারা যেতে পারি।’ পরে জানতে পারলাম, ওর সামনেই দুইজন বাংলাদেশি মারা গেছে।

মেরাজ গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন, পরে সেখান থেকে পালিয়ে মস্কোতে বাংলাদেশ দূতাবাসে আশ্রয় নিয়ে দেশে ফেরেন।

ব্র্যাকের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাগেরহাটের আয়ন মণ্ডল, কুমিল্লার অমিত বড়ুয়া এবং ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের মোহসিন আহমেদও একইভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হন।

আয়নের পরিবার জানিয়েছে, মাস কয়েক আগে তিনি ফোনে জানান যে তাকে ইউক্রেন সীমান্তের দিকে নেওয়া হচ্ছে, এরপর আর যোগাযোগ নেই। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছেন।

অমিত বড়ুয়ার একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে, যেখানে তাকে রুশ সেনা পোশাকে দেখা যায়। তার কোনো খোঁজ নেই এখনো।

এ বিষয়ে সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মানবপাচার দমন শাখা) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গত দুই বছরে রাশিয়ায় পাচারের ঘটনায় ছয়টি মামলা হয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা অন্তত ১০ জনকে অবৈধভাবে রাশিয়ায় পাঠানোর প্রমাণ পেয়েছি। এদের মধ্যে দুইজন ফিরেছেন, একজনের সঙ্গে যোগাযোগ আছে, বাকিরা নিখোঁজ। ধারণা করছি, ৩০ জনের বেশি বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন।

ব্র্যাক জানিয়েছে, বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সিআইডিকে জানানো হয়েছে। একইসঙ্গে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে আইনি ও মানসিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

রিপোর্টে বলা হয়, এই ঘটনা বাংলাদেশের অভিবাসন ব্যবস্থার বড় দুর্বলতা প্রকাশ করেছে। শক্ত নজরদারি না থাকলে বৈধ অভিবাসনপথ মানবপাচারের অস্ত্র হয়ে উঠবে।

ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, আমরা এখনো জানি না কতজন বাংলাদেশি যুদ্ধক্ষেত্রে আটকা আছেন বা নিহত হয়েছেন। নিয়মিত নতুন নতুন মৃত্যুসংবাদ আসছে।

তিনি আরও বলেন, একজন বাংলাদেশি যুবক, যিনি ‘মো. সোহেল’ নামে ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্ট চালান, তিনি অন্যদের রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধে যোগ দিতে উৎসাহিত করছেন, অথচ কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।

যদি এখনই ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে আরও অনেক মানুষের জীবন যাবে, সতর্ক করেন শরিফুল হাসান।

ব্র্যাকের প্রতিবেদনে আহ্বান জানানো হয়েছে, সরকার যেন দ্রুত জাতীয় পর্যায়ে অনুসন্ধান ও উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করে, এবং সচেতনতামূলক প্রচার চালায়, যাতে কেউ আর ‘বৈধ ভিসার নামে যুদ্ধক্ষেত্রে’ না পড়ে।