ভূমিকম্প ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ: ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি ও করণীয়

ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে ভূমিকম্প কেবল একটি ভৌগোলিক ঘটনা নয়, বরং এটি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য একটি সতর্কবার্তা। যখন পৃথিবীতে পাপাচার, অনাচার ও আল্লাহবিমুখতা বেড়ে যায়, তখন আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সতর্ক করার জন্য বিভিন্ন প্রাকৃতিক নিদর্শন পাঠান। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, “আমি ভয় দেখানোর জন্যই (তাদের কাছে) নিদর্শনসমূহ পাঠাই।” (সূরা বনি ইসরাইল: ৫৯)।

রাসূলুল্লাহ (স.)-এর যুগে সরাসরি ভূমিকম্পের সময় তিনি কী করতেন, তার সুনির্দিষ্ট বিবরণ পাওয়া না গেলেও ঝড়-তুফান বা গ্রহণ বা অন্য কোনো ভীতিকর পরিস্থিতির সময় তিনি যে আমলগুলো করতেন, ফকিহ ও আলেমগণ ভূমিকম্পের সময় সেগুলো করার নির্দেশনা দিয়েছেন।

১. আল্লাহর জিকির ও ইস্তিগফার করা:

ভূমিকম্প বা বিপদের সময় আতঙ্কিত না হয়ে মহান আল্লাহর জিকির করা এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা সুন্নাহ। রাসূলুল্লাহ (স.) সূর্যগ্রহণের সময় নির্দেশ দিয়েছিলেন, “যখন তোমরা এমন কিছু (ভীতিকর নিদর্শন) দেখবে, তখন তোমরা ভীত হয়ে আল্লাহর জিকির, দুআ ও ইস্তিগফারে মশগুল হও।” (সহিহ বুখারি: ১০৫৯)।

২. দোয়া করা:

বিপদের মুহূর্তে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া মুমিনের হাতিয়ার। ভূমিকম্পের জন্য হাদিসে নির্দিষ্ট কোনো দোয়া বর্ণিত নেই, তবে যেকোনো বিপদে পড়ার দোয়াগুলো এ সময় পড়া যায়। যেমন—

“লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমিন।”
অর্থ: আপনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, আপনি পবিত্র। নিশ্চয়ই আমি পাপাচারীদের অন্তর্ভুক্ত।

৩. দান-সদকা করা:

সদকা বা দান আল্লাহর ক্রোধ প্রশমিত করে এবং বিপদ দূর করে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “নিশ্চয়ই দান-সদকা আল্লাহর রাগ প্রশমিত করে এবং অপমৃত্যু রোধ করে।” (তিরমিজি)। তাই দুর্যোগের সময় সাধ্যমতো দান করা উচিত।

৪. সালাত আদায় করা:

প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় নফল নামাজে দাঁড়িয়ে যাওয়া একটি উত্তম আমল। ভীতিকর পরিস্থিতিতে রাসূল (স.) দ্রুত মসজিদে যেতেন এবং নামাজে দাঁড়াতেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতে, ভূমিকম্পের সময় ঘরে একাকী নফল নামাজ আদায় করা মোস্তাহাব।

৫. সতর্কতা ও নিরাপত্তা গ্রহণ:

ইসলামে তাওয়াক্কুল (আল্লাহর ওপর ভরসা) মানে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা নয়। বরং আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা শরিয়তেরই নির্দেশ। তাই ভূমিকম্পের সময় নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়া এবং ধীরস্থির থাকা ঈমানের পরিপন্থী নয়, বরং তা ‘আসবাব’ বা উপকরণ গ্রহণের অন্তর্ভুক্ত।

ভূমিকম্প বা যেকোনো দুর্যোগ মূলত আমাদের আত্মশুদ্ধির সুযোগ করে দেয়। হযরত উমর (রা.)-এর খেলাফতকালে মদিনায় ভূমিকম্প হলে তিনি বলেছিলেন, “হে মদিনাবাসী! তোমরা নিশ্চয়ই কোনো নতুন পাপাচার শুরু করেছ... যদি আবার এমন হয়, তবে আমি তোমাদের সাথে আর এখানে থাকব না।” (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা)। তাই ভূমিকম্পের সময় কেবল ভয়ে ভীত না হয়ে, আল্লাহর কাছে তওবা করা এবং নিজেদের শুধরে নেওয়াই হলো প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্য।