কঙ্গোর সংঘাত: শরণার্থীর ঢলে বুরুন্ডিতে ভয়াবহ মানবিক সংকট

গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের (ডিআর কঙ্গো) পূর্বাঞ্চলে রুয়ান্ডা-সমর্থিত এম২৩ বিদ্রোহীদের হামলা ও গুরুত্বপূর্ণ শহর দখলের জেরে প্রতিবেশী দেশ বুরুন্ডিতে চরম মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে গত কয়েক দিনে অন্তত ৮৪ হাজার মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে বুরুন্ডিতে আশ্রয় নিয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, শরণার্থীর এই ঢলে বুরুন্ডির পরিস্থিতি এখন শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে।

ইউএনএইচসিআর শুক্রবার জানায়, ডিআর কঙ্গোর দক্ষিণ কিভু প্রদেশে চলমান সহিংসতা থেকে বাঁচতে হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন পায়ে হেঁটে কিংবা নৌকায় করে বুরুন্ডিতে প্রবেশ করছে। হঠাৎ বিপুল সংখ্যক মানুষের আগমনে স্থানীয় সম্পদ ও অবকাঠামোর ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়েছে এবং পরিস্থিতি একটি বড় মানবিক জরুরি অবস্থায় রূপ নিয়েছে। সংস্থাটি এই সংকট মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক আন্তর্জাতিক সাহায্যের আহ্বান জানিয়েছে। এখন পর্যন্ত বুরুন্ডিতে সব মিলিয়ে আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা ২ লাখ ছাড়িয়েছে বলে জানা গেছে।

সংস্থাটি আরও জানায়, সাম্প্রতিক সহিংসতায় নারী ও শিশুরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সীমান্তে পৌঁছানো এই মানুষগুলো চরম ক্লান্তি ও মানসিক আঘাত নিয়ে আসছে। অনেক গর্ভবতী নারী জানিয়েছেন, তারা গত কয়েক দিন ধরে কোনো খাবার পাননি।

চলতি ডিসেম্বরের শুরুতে এম২৩ বিদ্রোহী গোষ্ঠী হামলা জোরদার করলে এই গণপলায়ন শুরু হয়। অভিযানের এক পর্যায়ে তারা উভিরা শহর দখল করে নেয়, যেখানে কয়েক লাখ মানুষের বসবাস ছিল। গত ৫ ডিসেম্বর থেকে শরণার্থীরা বুরুন্ডিতে ঢুকতে শুরু করে এবং ১০ ডিসেম্বর উভিরা দখলের পর এই সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে বুধবার এম২৩ দাবি করে যে তারা শহরটি থেকে সরে যাচ্ছে।

তবে বুরুন্ডিতে আশ্রয় নেওয়া পরিবারগুলোর দিন কাটছে চরম দুর্দশায়। অস্থায়ী শিবির ও ট্রানজিট পয়েন্টগুলোতে ন্যূনতম অবকাঠামোও নেই। অনেক মানুষ খোলা আকাশের নিচে বা গাছের নিচে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে পর্যাপ্ত পানীয় জল ও স্যানিটেশনের অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। বাস্তুচ্যুতদের প্রায় অর্ধেকই ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু এবং অসংখ্য নারী, যাদের মধ্যে অনেকেই গর্ভবতী।

বুরুন্ডির অর্থনৈতিক সম্প্রদায়ের (ইসিসিএএস) প্রেসিডেন্ট এজেকিয়েল নিবিগিরা জানান, পশ্চিম বুরুন্ডির গাটুম্বায় প্রায় ২৫ হাজার এবং উত্তর-পশ্চিমের বুগান্ডায় প্রায় ৪০ হাজার শরণার্থী অবস্থান করছে। এই শরণার্থীদের অধিকাংশই এখন নিঃস্ব।

পরিস্থিতির ভয়াবহতা উল্লেখ করে রুমোঙ্গের প্রশাসক অগাস্টিন মিনানি বলেন, ‘পরিস্থিতি বিপর্যয়কর এবং অধিকাংশ মানুষ ক্ষুধায় মারা যাচ্ছে।’

শরণার্থীরা জানিয়েছেন, তারা নিজ চোখে বোমাবর্ষণ ও গোলাবর্ষণ দেখেছেন। কেউ কেউ স্বজনদের হারিয়েছেন, আবার অনেকে বয়স্ক স্বজনদের পথে ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছেন।

এদিকে এম২৩ নেতৃত্ব জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও কাতারের মধ্যস্থতায় চলা শান্তি প্রচেষ্টাকে সমর্থন জানাতে এবং আস্থা তৈরির পদক্ষেপ হিসেবে তারা উভিরা থেকে সরে যাচ্ছে। তবে কঙ্গোর যোগাযোগমন্ত্রী প্যাট্রিক মুইয়া বিদ্রোহীদের এই ঘোষণা নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, এটি মূলত রুয়ান্ডার ওপর চাপ কমানোর একটি কৌশল মাত্র। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, বৃহস্পতিবারও উভিরা শহরে এম২৩-এর পুলিশ ও গোয়েন্দা সদস্যদের অবস্থান করতে দেখা গেছে।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে গোমা এবং ফেব্রুয়ারিতে বুকাভু দখল করে এম২৩ তাদের নিয়ন্ত্রণ বিস্তৃত করেছে। খনিজসমৃদ্ধ পূর্ব ডিআর কঙ্গোর বড় একটি এলাকা এখন বিদ্রোহীদের দখলে থাকায় বুরুন্ডি সীমান্তঘেঁষা কঙ্গোলিজ বাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ পথ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

উল্লেখযোগ্য যে, ডিআর কঙ্গো ও রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্টদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওয়াশিংটনে বৈঠকের এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে উভিরা অভিযানটি শুরু হয়। ওই বৈঠকে শান্তিচুক্তির প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছিল। শহর দখলের ঘটনায় ওয়াশিংটন তীব্র সমালোচনা করে এবং চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে। রুয়ান্ডা অবশ্য এম২৩-কে সমর্থনের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

আঞ্চলিক কর্মকর্তা ও মানবিক সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বরের শুরু থেকে চলমান সহিংসতায় ডিআর কঙ্গোতে চার শতাধিক বেসামরিক মানুষ নিহত এবং দুই লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। জাতিসংঘের হিসেবে, দেশটির পূর্বাঞ্চলে সক্রিয় শতাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠীর কারণে দীর্ঘদিনের সংঘাতে মোট বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ৭০ লাখের বেশি।