আপনি পড়ছেন

আজ হিজরি মাস মহররমের ১০ তারিখ, পবিত্র আশুরা। প্রায় ১ হাজার ৩৩৫ বছর আগে, ৬১ হিজরি সনের আজকের এই দিনে কী ঘটেছিল ফোরাত নদীর তীরে? কারবালার প্রান্তরে সেদিনের সেই ঘটনা কী শিক্ষা বহন করছে মুসলিমদের জন্য?

battle of karbala

ইতিহাস থেকে জানা যায়, স্বৈরশাসক এজিদের দুঃশাসন এবং অনৈতিক চর্চা কোনভাবেই মেনে নিতে পারেননি ইমাম হোসেন (রা.)। তাই ইমাম হোসাইনের (রা.) সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ছিল খিলাফত ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন ঘটানো। মুসলিম জাহানের বিপুল মানুষের সমর্থনও ছিল তার প্রতি। এমন কি কুফাবাসী এজিদের অপশাসনের হাত থেকে বাঁচার জন্য বারবার ইমাম হোসাইনের সাহায্য প্রার্থনা করেছিল। ইমাম তাদের সেই আবদনে সাড়া দিয়েছিলেন।

হোসাইন (রা:) কুফা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কুফার অবস্থা জানার জন্য তিনি তার চাচাতো ভাই মুসলিম-বিন-আকিলকে সেখানে পাঠান। আকিল কুফাবাসীর সাহায্যের আশ্বাস পেয়ে ইমাম হোসাইনকে কুফায় আসতে অনুরোধ করে পত্র লেখেন। কিন্তু এরই মধ্যে এজিদের অনুগত ইরাকের শাসনকর্তা ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ, আকিলকে আটক করে নৃশংসভাবে হত্যা করে এবং তার সহায়তাকারীদেরও নির্মমভাবে হত্যা করে।

yeazid force photo from movieইয়াজিদ-বাহিনী (চলচ্চিত্র থেকে নেয়া)

ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদের এমন নিষ্ঠুরতা দেখে কুফাবাসী ভীত হয়ে পড়ে এবং হোসাইন (রা:)-কে সহায়তা করার সাহস হারিয়ে ফেলে। কুফাবাসী ইমাম হোসাইন (রা:)-কে খলিফা হিসেবে দেখতে চাইলেও তাঁর জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতে রাজি ছিল না। এজিদের নির্মমতার কথা জেনেও ইমাম হোসাইন (রা:)-এর কিছু সঙ্গী জেনে-শুনে এবং বুঝেই তার সাথে যোগ দিয়েছিলেন। ইমাম (রা:)-কে ভালোবেসে, তার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস রেখেই তারা ইমামের সাথে থেকে প্রাণপণে সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন।

ইমাম হোসাইন (রা:) এবং তার সঙ্গীদের ওপর যে আঘাত হানা হয়েছে, তরবারির সেই আঘাতের যন্ত্রণার চেয়ে আরো বেশি কষ্টকর ছিল জনগণের অজ্ঞতা এবং মূর্খতার আঘাত। সে জন্যই জনতার চিন্তার ভূবন থেকে অজ্ঞতার পর্দা অপসারণ করাটাই ছিল তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ জিহাদ।

আকিলের পাঠানো পত্র পেয়ে ইমাম হোসাইন স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, আত্মীয়স্বজন ও অনুচরসহ কুফার পথে রওনা হন। কুফায় এজিদ বাহিনীর সেনাপতি ওমর এজিদের আনুগত্যের শপথ গ্রহণের নির্দেশ দিলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে তারা ফোরাত নদীর তীর ঘিরে ফেলে এবং হোসাইন (রা:) শিবিরের পানি সরবরাহের পথ বন্ধ করে দেয়।

battle of karbala artআব্বাস আল-মুসাভী (কারবালার যুদ্ধ, ১৯শতকের শেষ দিকে এবং ২০ শতকের শুরুর দিকে আঁকা), ব্রুকলিন জাদুঘর।

আশুরার দিনে কারবালার পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে ধাবিত হতে থাকে। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও ইমামের (রা:) সঙ্গীরা অবিচল আস্থা ও ঈমানের সাথে নিজেদের দায়িত্ব পালন করছিলেন। চরম সঙ্কটময় পরিস্থিতিতেও তারা ইমামের সাথে তাদের অঙ্গীকার ও বিশ্বাস ভঙ্গ করেননি।

এ অনড় ঈমানের অধিকারী একজন ছিলেন হজরত আব্বাস (রা:)। তার মা ছিলেন উম্মুল বানিন। হজরত আব্বাস ছিলেন অকুতোভয় এক যুবক। তার ঈমান, বীরত্ব, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক গুণাবলির কথা ছিল প্রবাদতুল্য। দেখতেও তিনি ছিলেন খুব সুন্দর। কারবালার অসম যুদ্ধে তিনিই ছিলেন ইমাম (রা:) পরে প্রধান সিপাহসালার। ইমামের প্রতিরক্ষা, নারী ও শিশুদের তাঁবুর প্রতিরক্ষা এবং ইমাম হোসাইন (রা:)-এর সন্তানদের জন্য পানির ব্যবস্থা করতে প্রাণপণে লড়েছেন তিনি।

অবশেষে ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের চার হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী ইমাম হোসাইনকে (রা:) অবরুদ্ধ করে ফেলে এবং ফোরাত নদীতে যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেয়। পানি সরবরাহের পথ বন্ধ করে দেয়ায় ইমামের (রা:) কচি সন্তানেরা প্রচণ্ড তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়লে হজরত আব্বাস (রা:) ফোরাতে যান পানি আনতে।  তিনি নিজেও ভীষণ তৃষ্ণার্ত ছিলেন।

আঁজলা ভরে পানি তুলে খেতে যাবেন এমন সময় তার মনে পড়ে যায় ইমাম হোসাইন (রা:)-এর তৃষ্ণার্ত শিশু সন্তানের কথা। পানি ফেলে দিয়ে মশক ভর্তি করে তাঁবুর উদ্দেশ্যে রওনা দিতেই শত্রু র আঘাতে তার এক হাত কেটে যায়। মশকটাকে তিনি অন্য হাতে নিয়ে ইমামের (রা:) তাঁবুর দিকে ছুটলেন। এবার অন্য হাতটিও কাটা পড়ে। মশকটাকে এবার তিনি মুখে নিয়ে তাঁবুর দিকে যেতে চাইলেন। শত্রুর তীর এবার সরাসরি তার দেহে আঘাত হানে। এভাবে শহীদ হয়ে যান তিনি।

এরপর অসম এ যুদ্ধে একে এক ৭২ জন শহীদ হন। কারবালায় আরো যারা শহিদ হন তাদের মধ্যে রাসূলের (সা:) প্রিয় সাহাবা হাবিব ইবনে মাজাহের, মুসলিম ইবনে আওসাজা, নওমুসলিম ওহাব (রা.) সহ আরো অনেকেই ছিলেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, দুরাবস্থায় পতিত হয়ে হোসাইন (রা:) ওবায়দুল্লাহর কাছে তিনটি প্রস্তাবের যেকোনো একটি গ্রহণের অনুরোধ জানান। তা হলো- হয় তাকে মদিনায় ফেরত যেতে দেয়া হোক, কিম্বা তুর্কি সীমান্তের দুর্গে অবস্থান করতে দেয়া হোক অথবা, এজিদের সাথে আলোচনার জন্য দামেস্কে যেতে দেয়া হোক।

কিন্তু মতাদর্পী ওবায়দুল্লাহ এর কোনোটাই মানেনি। এদিকে ১০ দিন অবরুদ্ধ থাকার কারণে পানির অভাবে হোসাইন (রা:)-এর শিবিরে হাহাকার পড়ে যায়। ছোট শিশুরা মুর্ছা যেতে শুরু করে। নিরুপায় হোসাইন শেষবারের মতো অনুরোধ করলেও পাষণ্ডদের মন গলেনি। ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ অক্টোবর কারবালার প্রান্তরে হয়ে যায় এক অসম যুদ্ধ। যেখানে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে মহানবী (সা.)এর দৌহিত্র হোসাইন (রা.) শাহাদাত বরণ করেন। 

হোসাইন (রা:) পরিবারের জীবিত সদস্যদের বন্দী করে দামেস্কে এজিদের কাছে পাঠানো হয়। এ দিকে হোসাইনের (রা:) মৃত্যুর এমন ভয়াবহ দৃশ্য পুরো দেশের মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলে। এতে এজিদ ভয় পেয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে জনরোষের ভয়ে কৌশলী ভূমিকা নিয়ে সে বন্দীদের মুক্ত করে মদিনায় পাঠিয়ে দেয়।

মহররমের এই ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম হৃদয়বিদারক এক অধ্যায়। মহররম শিক্ষা দেয়, চরম দুঃসময়েই সাহস না হারানোর এবং অন্যায় যতো বৃহতই হোক না কেনো, তার সামনে মাথা নত না করার। 

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর