আপনি পড়ছেন

ইসলামে ইমামকে বলা হয় সমাজের নেতা। আর মুয়াজ্জিন হলেন নামাজের আহ্বানকারী। তারা অবশ্যই প্রথম শ্রেণির সম্মানিত ব্যক্তি। কিন্তু মাস শেষে তাদের যে সম্মানী বা ভাতা দেয়া হয় সেটা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। রাজধানীতে ইমাম সাহেবরা সম্মানী পান পাঁচ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা, মুয়াজ্জিনরা পান সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা। রাজধানীর বাইরে অধিকাংশ মসজিদের ইমাম সাহেবদের সম্মানী দুই থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা। আর মুয়াজ্জিনদের মাসিক সম্মানী দেয়া হয় নামমাত্র। এই অল্প টাকায় অভাব অনটনে কেটে যায় ইমাম-মুয়াজ্জিনদের কষ্টের জীবন।

muslim prayer imam

দেশব্যাপী সম্মানিত ইমাম-মুয়াজ্জিনদের অভাব-অনটনের টানাটানির জীবন-সংসার নিয়ে অনুসন্ধান চালান প্রতিবেদক যাকারিয়া ইবনে ইউসুফ। অনুসন্ধানে যে চিত্র উঠে এসেছে তা সত্যিই লজ্জার।

রাজধানী ঢাকায় মোটামুটি মানের দুই রুমের একটি বাসা ভাড়া নিয়ে পরিবারসহ থাকতে প্রয়োজন কমপক্ষে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। মসজিদের শহর এই ঢাকার ইমাম-মুয়াজ্জিনদের জন্য যেটি অনেকখানি আকাস-কুসুম কল্পনা। রাজধানীর প্রায় প্রত্যেক ইমাম-মুয়াজ্জিনই মাস শেষে নামমাত্র সম্মানী পান। রাজধানীর বাইরের অবস্থা আরও করুণ। এত কম টাকায় তাদের পক্ষে সংসার চালানো একেবারেই অসম্ভব। এই 'অসম্ভবকে সম্ভব করতেই' মসজিদের জিম্মাদারির পাশাপাশি ইমাম-মুয়াজ্জিনরা বাসাবাড়িতে দোয়া অথবা মিলাদ অনুষ্ঠান পরিচালনা কিংবা প্রাইভেট পড়ানোসহ টুকটাক ব্যবসা করতে বাধ্য হন।

সম্মানীর শোচনীয় হাল: ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে ফজর থেকে এশা পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সঠিক সময়ে পড়ান মসজিদের ইমাম। আর নামাজের আগে মুসলিমদের মসজিদের আসার আহ্বান জানিয়ে আজান ও ইক্বামত দেন মুয়াজ্জিন। আর মাস শেষে তারা পান অত্যন্ত নিম্নমানের সম্মানী। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে শহরাঞ্চলের কোনো কোনো মসজিদে ইমাম-মুয়াজ্জিনকে মাসিক বেতন দেয়া হয় দুই-তিন হাজার টাকা মাত্র। মফস্বলের গ্রামগুলোর কিছু মসজিদে দেয়া হয় বিভিন্ন মৌসুমের ধান বা চাল।

বিভিন্ন মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খতিবরা জানান, শহরের বাইরের মসজিদগুলোতে আয় হয় অনেক কম। ফলে মসজিদ কমিটির তহবিলও অনেক কম। গ্রামের মসজিদগুলোতে মাসিক হারে দুশ’ থেকে তিনশ’ টাকা এবং অনেক মসজিদে আবার বার্ষিক হারে ৫/৬ হাজার টাকা দেয়ারও নজির আছে। তবে শহরের খতিবরা প্রতি শুক্রবার জুম্মার নামাজ পড়িয়ে গড়ে ৫০০ থেকে ৪-৫ হাজার টাকা সম্মানী পান।

বেসরকারি মসজিদে নেই কোন নিয়ম-নীতি: ২০০৬ সালে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় ‘মসজিদ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা’ প্রণয়ন করলেও ইমাম-মুয়াজ্জিনদের সম্মানীর বেলায় কোন বাধ্যবাধকতা না থাকায় মসজিদ কমিটিগুলো মানে না এসব নিয়ম।

এক হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালে দেশে জামে মসজিদের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩ লাখ। আর প্রত্যেকটি মসজিদেই একজন করে ইমাম রয়েছেন। অথচ ইসলামিক ফাউন্ডেশন বলছে, সারা দেশে মাত্র ৪টি মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন পূর্ণাঙ্গরূপে সরকারি বেতন-ভাতা ও সুবিধা পান। এ মসজিদগুলো হল- জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম, চট্টগ্রামের জমিয়তুল ফালাহ, আন্দরকিল্লা মসজিদ ও রাজশাহীর হেতেম খাঁ মসজিদ। এছাড়া রাজধানীর বঙ্গভবন জামে মসজিদ, গণভবন জামে মসজিদ ও সচিবালয়ের মসজিদ কিছু সরকারি সুবিধা পায়। দেশের সরকারি মসজিদগুলোয় ইমাম-মুয়াজ্জিনদের জীবনযাপনের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হলেও সারা দেশের বেসরকারি মসজিদগুলোতে সরকারি নীতিমালাটি উপেক্ষিত। পালনের বাধ্যবাধকতা না থাকায় কোনো মসজিদেই নিয়মটি মানা হয় না।

muslim prayer muzzin new

সেই নীতিমালায় কী আছে: ২০০৬ সালের ১৫ নভেম্বর ধর্ম মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে মসজিদ পরিচালনা, পরিচালনা নীতি, কমিটি, মসজিদের পদবিসহ বেতনকাঠামো নির্ধারণ করা হয়। তবে প্রজ্ঞাপন প্রকাশের ১১ বছর হলেও আজ পর্যন্ত সরকারের তরফ থেকে এটি পালনে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

নীতিমালায় মসজিদের আটটি পদের কথা উল্লেখ রয়েছে। পদগুলোর বিপরীতে বেতন ও ভাতার হার হল- খতিবের সম্মানী চুক্তি অনুযায়ী, সিনিয়র পেশ ইমামের বেতনস্কেল ১৩৭৫০-৫৫০-১৯২৫০ টাকা, পেশ ইমামের ১১০০০-৪৭৫-১৭৬৫০ টাকা, ইমামের ৬৮০০-৩২৫-৯০৭৫ ইবি-৩৬৫-১৩০৯০ টাকা, প্রধান মুয়াজ্জিনের ৫১০০-২৮০-৫৮৫০-ইবি-৩০০-১০৩৬০ টাকা, জুনিয়র মুয়াজ্জিনের ৪১০০-২৫০-৫৮৫০-ইবি-২৭০-৮৮২০ টাকা, প্রধান খাদিমের ৩১০০-১৭০-৪২৯০-ইবি-১৯০-৬৩৮০ টাকা এবং খাদিমের ৩০০০-১৫০-৪০৫০-ইবি-১৭০-৫৯২০ টাকা।

নীতিমালার ১৯ ধারা এর দুই উপধারায় উল্লেখ আছে, সরকার পরিচালিত মসজিদেও বেতনকাঠামো অনুসরণ করা যেতে পারে। অন্যান্য মসজিদে মসজিদ পরিচালনা কমিটি তাদের আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী আলোচনার মাধ্যমে বেতন-ভাতা নির্ধারণ করবেন।

জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সিনিয়র ইমাম মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাক্বী বলেন, ২০০৬ সালে প্রথমবারের মতো নীতিমালা প্রণয়ন হয়। পরবর্তী সময়ে প্রজ্ঞাপনটির কোনো অগ্রগতি জানা যায়নি। ফলে ইমাম-মুয়াজ্জিনরা মসজিদ পরিচালনা কমিটির সিদ্ধান্তেই সম্মানী নেন। আর পেশাটার সঙ্গে যেহেতু সম্মান আর দ্বীনের ব্যাপার রয়েছে তাই সম্মানী নিয়ে ইমাম-মুয়াজ্জিনরা কোনো কথা বলেন না। তবে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায় ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের এমন উপযুক্ত সম্মানী দেয়া উচিত। এতে ইমামরা মানসিক অস্থিরতা ও আর্থিক দুবর্লতা কাটিয়ে উঠতে পারবেন। ইমামদের প্রাপ্য সম্মান দিলে সমাজের সবাই উপকৃত হবে।

চাকরি চ্যুত হলে বিদায় নিতে হয় খালি হাতে: দেশব্যাপী বিভিন্ন মসজিদে ইমাম-মুয়াজ্জিনদের নিয়োগ এবং চাকরি থেকে ছাঁটাই সবকাজ করে মূলত মসজিদ কমিটি। ইমামদের সংগঠন জাতীয় ইমাম সমাজ বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটির মহাসচিব মুফতি মিনহাজ উদ্দীন বলেন, 'ইমাম-মুয়াজ্জিনদের সম্মানী ভাতা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এর মধ্যে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা হলো, যখন-তখন একজন ইমাম বা মুয়াজ্জিনকে চাকরি থেকে অব্যহতি বা বহিষ্কার করা হয়। কোনো মসজিদে ২০-৩০ বছর ধরে কেউ ইমামতি করছেন; কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে কয়েক সপ্তাহ নামাজ পড়াতে পারেননি। তখন তাকে মসজিদ পরিচালনা কমিটি অপসারণ করে। শুধু তাই নয়, যে মানুষটি ২০-৩০ বছর ধরে নামাজ পড়িয়েছেন তাকে বিদায় নিতে হয় একদম খালি হাতে। অনেকে ইমামতি করতে করতে বার্ধক্যে চলে যান। এ ক্ষেত্রেও তার অর্জন একেবারে শূন্য। সেক্ষেত্রে ইমামদের অবসরভাতা বা প্রভিডেন্ট ফান্ডের ব্যবস্থা করা গেলে ভালো হবে।'

muslim prayer

সম্মানী বাড়ে ধীর গতিতে: অন্যান্য চাকরিতে বছরান্তেই বিভিন্ন ইনক্রিমেন্টসহ বিভিন্ন ভাতার মাধ্যমে বেড়ে যায় মাসিক বেতন। কিন্তু ইমামদের ক্ষেত্রে সম্মানীটা বাড়ে কচ্ছপ গতিতে। রাজধানীর নাজিমউদ্দীন রোডে অবস্থিত কবিরাজ মসজিদে ১৭ বছর ধরে ইমামতি করছেন মাওলানা এনামূল হক রাশেদী। চাকরির শুরুতে তার সম্মানী ছিল মাত্র এক হাজার টাকা। ১৭ বছর পর বর্তমানে তার সম্মানী ছয় হাজার টাকা। মাওলানা এনামূল হক রাশেদী বলেন, 'আমরা যারা আল্লাহর রাস্তায় যারা কাজ করি তারা সম্মানী-ভাতা নিয়ে চিন্তিত নই। তবে সত্যিটা হল ইমামদের যে সম্মানীভাতা দেয়া হয় সেটা বর্তমান বাজারদরে ন্যূনতম। এ টাকায় সম্মানের সঙ্গে জীবিকা নির্বাহ করা সম্ভব নয়।'

২০১৫ সালের জুনে তেজগাঁও শিল্প এলাকার নূরে দারুস সালাম জামে মসজিদে ইমাম হিসেবে নিয়োগ পান হাফেজ মাওলানা আশরাফ আলী। এখন তার সম্মানী সাড়ে সাত হাজার টাকা। তিনি বলেন, তুলনামূলক কম দামের হোটেলে খেতে হয় আর মসজিদে থাকি। এ অল্প সম্মানীতে আমার স্ত্রী আর দেড় বছরের কন্যাকে ঢাকায় নিয়ে আসার সুযোগ নেই। এ মসজিদেই ১৯৯৯ সালে মুয়াজ্জিন হিসেবে এক হাজার টাকা বেতনে যোগ দেন মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম। ১৮ বছর পর বর্তমানে তার সম্মানী মাত্র সাড়ে ৪ হাজার। অভাব-অনটনের কারণে তার দুই ছেলে মাদ্রাসা লাইনে আলিম (ইন্টারমিডিয়েট) পাস করার পর ফাজিলের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেনি। বছরে দুটি লুঙ্গি আর দুটি পাঞ্জাবি এবং মসজিদে থেকেই চলে তার জীবন।

তবে ব্যতিক্রমী চিত্রও আছে। রাজধানীতে কিছু মসজিদে সম্মানিটা তুলনামূলক ভালো। সেই ভালোটাই হল সর্বোচ্চ ১৫ হাজার। বিশ্বরোড খাদেমুল ইসলাম জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা আবদুল আজিজ। তিনি ১৮ বছর আগে ১৫০০ টাকায় ইমামতি শুরু করেন। বর্তমানে তার মাসিক সম্মানী ১৫ হাজার টাকা। তিনি বলেন, 'পরিবার-পরিজন নিয়ে এ সামান্য টাকায় ঢাকা শহরে চলাচল করা অসম্ভব। তাই মাদ্রাসার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছি।' ইমামদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য সম্মানীর ক্ষেত্রে জীবিকা নির্বাহের জন্য ন্যূনতম একটা সম্মানী নির্ধারণ করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের আইসিটি বিভাগের পরিচালক রফিক উল ইসলাম বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে ইমামদের কোনো সম্মানীই দেয়া হয় না। এ ধরনের কোনো নির্দেশনাও নেই। শুধুমাত্র ফাউন্ডেশনের গণশিক্ষা কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত শিক্ষকদের (ইমাম) সম্মানী দেয়া হয়। তবে ইমামদের সম্মানী ভাতা দেয়ার জন্য আমাদের ডিজি বাংলাদেশের সব মসজিদকে গণশিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় আনার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।' বর্তমানে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গণশিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় প্রায় ৭০ হাজার ইমাম আছেন বলে জানান তিনি।

Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.

Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.