আপনি পড়ছেন

মানুষটা ছিলেন শখের কবি। সময়-অসময়ে মনের আনন্দে-বিরহে দুই-চার লাইন লিখেও ফেলতেন চট করে। কে জানতো, পরবর্তীতে এই কবি মানুষটার কলম দিয়েই কবিতার লাইনের পরিবর্তে 'আঁকা' হবে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর পরোয়ানা!

ak 47 kalashnikov

এক সময় এই শখের কবিটির হাত ধরে পৃথিবীতে যে আগ্নেয়াস্ত্রের জন্ম হলো তা এক কথায় অবিশ্বাস্য। বিশ্বজুড়ে একাধারে আলোচিত ও জনপ্রিয় এই আগ্নেয়াস্ত্রটির নাম ‘একে ফরটি সেভেন’। ‘কালাশনিকভ’ নামেও বেশ পরিচিত এটি। স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করা 'অটোমেটিক কালাশনিকভ'-শব্দ দুটির ইংরেজি আদ্যাক্ষর এবং তৈরির সাল নিয়ে রাইফেলটির নাম রাখা হয় ‘AK 47’।

‘কবি কবি’ পরিচয়ের আড়ালে প্রখর সৃষ্টিশীল এই মানুষটার নাম মিখাইল তিমোফিয়েভিচ কালাশনিকভ। তার নামানুসারেই আগ্নেয়াস্ত্রটির নাম রাখা হয় ‘কালাশনিকভ’। ১৯১৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের শীতপ্রধান অঞ্চল সাইবেরিয়ার কুরইয়া নামের এক গ্রামের দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম মিখাইল কালাশনিকভের। আর দশটা দরিদ্র কৃষক পরিবারের মতোই মিখাইলেরও ভাই-বোনের কমতি ছিলো না। অশিক্ষিত কৃষক বাবা-মা ফি বছর সন্তান জন্ম দিয়ে গেছেন নিরলসভাবে। ফলাফল উনিশ ভাইবোনের মধ্যে মিখাইলের অবস্থান সপ্তদশ!

ছোটবেলা থেকেই কবিতার প্রতি আগ্রহী ছিলেন মিখাইল। স্বপ্ন দেখতেন বড় হয়ে বিখ্যাত কবি হবেন। একই সাথে মেশিনারিজের প্রতি ছিলো তার দুর্নিবার আকর্ষণ। তবে সব স্বপ্নের পথেই বাধা ছিলো তার অসুস্থতা। ‘নিয়মিত’ অসুস্থ থাকার পাশাপাশি ছয় বছর বয়সে একবার মরতে বসেছিলেন মিখাইল। কোনোমতে সে যাত্রায় রক্ষা পান তিনি।

ak 47 kalashnikov 01মিখাইল তিমোফিয়েভিচ কালাশনিকভ

অর্থের কষ্টে মাত্র সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করার পর কুরইয়ার একটি ট্রাক্টর স্টেশনে চাকরি নেন মিখাইল। সেখানে চাকরি করা অবস্থায়ই অস্ত্রের প্রতি ভালোবাসা জন্মে তার। এরপর ১৯৩৮ সালে সোভিয়েত সরকারের নিয়মানুযায়ী বাধ্যতামূলকভাবে রেড আর্মিতে যোগ দেন তিনি। অস্ত্রের প্রতি তার আগ্রহ এবং মেকানিক্যাল কাজে তার পূর্বাভিজ্ঞতার কথা বিবেচনা করে মিখাইলকে একজন ট্যাংক মেকানিক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ধীরে ধীরে ২৪তম ট্যাংক রেজিমেন্টের সিনিয়র ট্যাংক কমান্ডার হিসেবে পদোন্নতি পান তিনি।

১৯৪১ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন চরমে। ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে জার্মান বাহিনীর কাছে একরকম নাকানি চুবানি খাচ্ছে সোভিয়েত শক্তি। এমনই এক কঠিন সময়ে ব্রায়ানস্কের যুদ্ধে জার্মান বাহিনীর গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হন মিখাইল। ছয় মাস ছুটি পেলেন। এই ছুটিই তার জন্য শাপে বর হয়ে এলো।

হাসপাতালের বেডে শুয়ে অলস সময় কাটানো ধাতে সইলো না মিখাইলের। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত জার্মান বাহিনীর কাছে নাস্তানাবুদ সোভিয়েত বাহিনীর কথা চিন্তা করেই সম্পূর্ণ নতুন ডিজাইনের একটি অস্ত্র আবিষ্কারের নেশায় অস্থির হয়ে উঠলো তার উদ্ভাবনী মন। হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে যে স্বপ্ন চারা হয়ে উঠেছিলো, সুস্থ হওয়ার পর ইজভেস্ক অস্ত্র কারখানায় গিয়ে সেই চারায় পানি দিতে শুরু করেন মিখাইল।

এরপর ১৯৪৪ সালে আমেরিকান এম-১ এবং জার্মান এসআইজি-৪৪ অস্ত্রের নকশার সমন্বয়ে সর্বপ্রথম একটি স্বয়ংক্রিয় কারবাইনের ডিজাইন করেন তিনি। তার ভাষায় ওই নকশায় সর্বোত্তম কৌশলের প্রয়োগ ঘটানো হয়েছিলো। কিন্তু বিধি বাম! বিভিন্ন খুঁত ধরে তার ওই নতুন ডিজাইনের কারবাইন গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায় যুদ্ধ কর্তৃপক্ষ।

একজন পাকা সৈনিকের স্বভাব অনুযায়ী স্বপ্ন কামড়ে পড়ে রইলেন মিখাইল। দুই বছর পর ১৯৪৬ সালে পূর্ববর্তী রাইফেলের উন্নত একটি সংস্করণ সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেন তিনি। এবারে নতুন এই ডিজাইন গ্রহণ করে কর্তৃপক্ষ। তবে নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর অল্প অল্প করে রি-ডিজাইনের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালে গিয়ে পূর্ণতা পায় AK 47।

নতুন উদ্ভাবিত এই কারবাইন রাইফেল ধীরে ধীরে সোভিয়েত বাহিনীর কাছে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। সেই ১৯৪৯ সালেই এই কালাশনিকভ রাইফেল দিয়ে মিনিটে ৬ শ’ গুলিবর্ষণ করা সম্ভব হচ্ছিল। একটি সাবমেশিনগানের এমন সক্ষমতা বিশ্বের অন্যান্য সামরিক বাহিনীর কাছে তখন রীতিমতো কল্পনা ছিলো।

সুযোগ বুঝে সোভিয়েত ইউনিয়নও বিশ্বের অন্যান্য দেশের কাছে ‘একে ৪৭’ রপ্তানি করতে শুরু করে। সহজ পরিচালনার কারণে উত্তরোত্তর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকায় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের চরম শত্রু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এক সময় ভিয়েতনাম যুদ্ধে নিজেদের তৈরি এম-১৬ রাইফেল ফেলে দিয়ে একে ৪৭ তুলে নিতে বাধ্য হয়।

তবে বহুল জনপ্রিয় এই স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের প্যাটেন্ট নিজেদের দখলে রাখতে পারেনি সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এই রাইফেলের স্বত্বাধিকার নিয়ে লড়ে যান মিখাইল। কিন্তু শেষপর্যন্ত তাকে একে ৪৭ রাইফেলের স্বত্ব ত্যাগ করতেই হয়। জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একে ৪৭ রাইফেল রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে তৈরি হতে থাকে। ফলে প্রথম এক দশকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ২ শ’ কোটি ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

আবিষ্কার হওয়ার পর থেকে একে-৪৭ পার করেছে ৬০ বছরেরও বেশি সময়। এই সময়ের মধ্যে এ আগ্নেয়াস্ত্রটি প্রায় ১০০ মিলিয়নেরও বেশি বার উৎপাদিত হয়েছে। বর্তমানে এই আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে প্রায় ৫০টিরও বেশি দেশে। বলা হয়, এ যাবত পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যুর কারণ গ্যাস পরিচালিত এই স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রটি।

সাম্প্রতিক পৃথিবীতে একে-৪৭ ছাড়া কোনো সামরিক বাহিনী কল্পনা করা অসম্ভব। ধারণা করা হয়, প্যাটেন্ট সংরক্ষিত না থাকায় আবিষ্কারের পর থেকে এ পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকারি, বেসরকারি অস্ত্র কারখানাগুলো প্রকাশ্যে, গোপনে একে-৪৭ উৎপাদন করেই যাচ্ছে। ফলে একে-৪৭ হচ্ছে, পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত রাইফেল এবং পৃথিবীতে গুলি খেয়ে মারা যাওয়া মানুষদের মধ্যে সিংহভাগের কপালে একে-৪৭ এর ১৬ দশমিক ৩ গ্রামের কার্টিজই জুটেছে!

একে-৪৭ -কে ধরা হয় বিশ্বের প্রথম কার্যকর অটোমেটিক রাইফেল। গ্যাস পরিচালিত স্বয়ংক্রিয় এই রাইফেলটির জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ এর সহজ ব্যবহার। প্রশিক্ষণে আসা নবিশ সৈনিকও এক-দুইবার দেখার পর অটোমেটিক এই রাইফেল পরিচালনা করতে সমর্থ হন। কালাশনিকভ রাইফেল ব্যবহারে যেমন সহজ তেমনি এর রক্ষণাবেক্ষণও নির্ভার। ধুলো-বালি, মাটি এবং পানিতে চুবানোর পরও একে-৪৭ সমানভাবে কাজ করতে থাকে। এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, একে-৪৭ এর উপর দিয়ে রাস্তা তৈরির রোলার চালিয়ে নেয়ার পরও এটি দিয়ে গুলি করা সম্ভব হচ্ছে!

জলে-স্থলে সমানভাবে ব্যবহার করা যায় বলে একে-৪৭ কে বলা হয়, পৃথিবীর সর্বস্থানে যে কোনো আবহাওয়ায় ব্যবহার উপযোগী রাইফেল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, এই রাইফেলে কখনোই ব্যাক ফায়ার হয় না। যা এই সময়ের অন্যান্য রাইফেলের ক্ষেত্রে কল্পনা করা অসম্ভব।

একে-৪৭ এর বুলেটের মারাত্মক ভেদ করার ক্ষমতা অন্যান্য রাইফেলের তুলনায় এটিকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। ১৬ দশমিক ৩ গ্রাম ওজনের ৭.৬২ x ৩৯ মি.মি এর প্রতিটি বুলেট সেকেন্ডে ৭১৫ মিটার ছুটে গিয়ে পাঁচ ইঞ্চি কংক্রিট অথবা আট ইঞ্চি কাঠ ভেদ করতে সক্ষম! একইসাথে এই রাইফেল দিয়ে সিঙ্গেল শট, বার্স্ট ফায়ার এমনকি গ্রেনেড ছোঁড়ারও সুবিধা রয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য সামরিক বাহিনীর সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও একে-৪৭ ব্যবহার করে থাকে।

একে-৪৭ আবিষ্কারের কারণে ২০০৯ সালের ১০ নভেম্বর রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পদক ‘হিরো অব রাশা’ উপহার পান মিখাইল তিমোফিয়েভিচ কালাশনিকভ। ২০১৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর ৯৪ বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে যান বিশ্বের ভয়ঙ্কর এই মারণাস্ত্রের জনক।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর

Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.

Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.