যেসব কারণে জাতিসংঘের সমর্থন পায়নি যুক্তরাষ্ট্র
- Details
- by তাইয়্যিপ আহসান রাফান
জেরুজালেম ইস্যুতে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে বিশ্বের ১২৮টি দেশ অবস্থান নিয়েছে। জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি ও ইসরায়েলের মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তরের বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিরোধিতার মুখে পড়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
সারা বিশ্বের ১৯৩টি দেশের মধ্যে ইসরায়েলসহ মাত্র ৯টি দেশ ছাড়া কেউ মার্কিন সিদ্ধান্তের পক্ষে ভোট দেয়নি। আর যারা পক্ষে ভোট দিয়েছেন তারাও (গুয়েতমালা, হন্ডুরাস, মার্শাল আইসল্যান্ড, নাউরু, পালো, টগো) অখ্যাত বা দুর্বল রাষ্ট্র হিসেবেই বিবেচিত। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ভারত ও সৌদির মতো দেশগুলোও ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ভোট দেয়ায় মার্কিন আধিপত্য হুমকির মুখে পড়েছে। এ ঘটনা আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের নতুন করে চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে।
এর আগে গত সোমবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদেও মার্কিন বিরোধী অবস্থান স্পষ্ট হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের ১৫টি দেশের মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া সবাই (১৪টি রাষ্ট্র) ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দেয়। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ভেটো ক্ষমতা সম্পন্ন দেশ হওয়ায় এ থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু সাধারণ অধিবেশনে ভেটো ক্ষমতা না থাকায় জেরুজালেম ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আনীত প্রস্তাব পাস হয়ে যায়।
কেন এভাবে মিত্র দেশগুলোও যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এ নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। বিশ্বের প্রধান প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলো এ বিষয়ে পাতার পর পাতা ছাপিয়ে চলেছে। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের নানা যুক্তিযুক্ত বিশ্লেষণে উঠে এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই করুণ অবস্থার কারণ।
ইসরায়েলের প্রতি অনাস্থা: এই ভোট আসলে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে। কারণ সারা বিশ্বে এ রাষ্ট্রটি একটি দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র হিসেবে ইতিমধ্যে নিজেদের পরিচিত করিয়েছে। তার জন্য রাজনৈতিকভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নৈতিক সমর্থন তারা পায়নি। এছাড়াও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আইনকে ইসরায়েল বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ফিলিস্তিনে নিজেদের দখলদারিত্ব ক্রমেই বাড়াচ্ছে। তাদের এই আগ্রাসী মনোভাবের কাছে কয়েক দশক ধরে আন্তর্জাতিক বিশ্ব মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনতে পারছে না। যার কারণে রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক বিশ্বে ইসরায়েলের গ্রহণযোগ্যতার মাত্রা কম।
কোটি কোটি ডলার খরচ করে নানা প্রচারণা চালিয়েও আন্তর্জাতিক বিশ্বকে নিজেদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেনি মার্কিন আনুকূল্যপ্রাপ্ত এ দেশটি। এ ধারণা ইসরায়েলের সাধারণ মানুষেরও।
আর্জেন্টিনার বংশোদ্ভূত ইসরায়েলি নাগরিক বিশিষ্ট পিয়ানো বাদক ও লেখক ডানিয়েল বারেনবইম গার্ডিয়ানে এক নিবন্ধে লেখেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে মার্কিন সিদ্ধান্ত (জেরুজালেম ইস্যুতে) একটি বাজে সিদ্ধান্ত। এক পক্ষকে খুশি করে অন্য পক্ষকে ক্ষুব্ধ করা এ সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যে কেবল অশান্তিই বাড়াবে। তিনি বলেন, ‘দুই রাষ্ট্র সমাধানই আসলে ইসরায়েলকে প্রকৃত নিরাপত্তা দেবে।’
ট্রাম্প প্রশাসনকে সংকেত: জাতিসংঘের এ ভোট ট্রাম্প প্রশাসনকে সংকেত দিয়েছে যে, একটি রাষ্ট্রের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব দেখিয়ে অযথা ক্ষমতা প্রয়োগের পক্ষে আন্তর্জাতিক বিশ্বের সমর্থন তিনি পাবেন না। ট্রাম্পের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি ভাড়াটে রাষ্ট্র, যা নখদন্তহীন বাঘের মত। যে কামড় দেয়ার চেয়ে হুংকার দেয় বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত নিক্কি হেলির হুংকারকে আন্তর্জাতিক বিশ্ব ভালোভাবে নেয়নি।
নিজেদের স্বকীয়তা প্রমাণে ট্রাম্পের বিপক্ষে অবস্থান: যেখানে ১২৮টি দেশ ট্রাম্পের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে সেখানে পক্ষে নেয়া ৯টি দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল ছাড়া অন্য কোনো দেশের আন্তর্জাতিক বিশ্বে কোনো গ্রহণযোগ্যতাই নেই। তাদের বেশিরভাগই অনেকটা দ্বীপরাষ্ট্রের মতো। আর ৩৫টি দেশ নীরবতা পালন করেছে। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন দিতে চাইলেও নৈতিকতার কারণে তারা তা পারেনি। ট্রাম্পকে সমর্থন দেয়া মানে নিজেদের দেউলিয়াত্ব প্রকাশ, রাজনৈতিক অসচেতনতা ও যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল সেনাবাহিনীর ভয়ে এ অনৈতিক কর্মকাণ্ডে সহযোগিতার শামিল বলে গণ্য হতে পারে বলে মার্কিন মিত্ররাও জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক বৃহৎ পরিসরে নিজেদের খাটো করেনি।
নিক্কি হেলির কূটনৈতিক ব্যর্থতা: জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত নিক্কি হেলির ব্যর্থতার কারণেও যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক বিশ্বের সমর্থন না পাওয়ার জন্য দায়ী। তার অহংকারী বক্তব্য বিশ্বের মর্যাদাসম্পন্ন দেশগুলোর নেতৃত্বের গায়ে লেগেছে। বিশ্বের অন্য রাষ্ট্রগুলো সাহায্য বন্ধ করে দেয়ার হুমকি ভালোভাবে নেয়নি। এটি তাদের সার্বভৌমত্বে আঘাত বলে মেনে নিতে পারেনি। আমেরিকার সাধারণ মানুষও মনে করছেন, নিক্কি হেলির কূটনৈতিক জ্ঞানের অপরিপক্কতার কারণে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন হারিয়েছে।
মুসলিম বিশ্ব ঐক্যবদ্ধ হওয়া: সারা বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ বায়তুল মোকাদ্দাস। বিশ্বের সব মত-পথ, শিয়া-সুন্নী, আরব-অনারব সবারই আবেগের স্থান জেরুজালেম। এই একটি ইস্যুতে সারা বিশ্ব এক। এজন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ট মিত্র হওয়ার পরও সৌদি আরব অধিবেশনের শেষ মিনিটে ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে।
এছাড়াও রাষ্ট্রীয় অভ্যন্তরীণ বিষয় ছাড়াও অতিমাত্রায় আন্তর্জাতিক বিশ্বের বিভিন্ন ইস্যুতে নাক গলানোসহ বিভিন্ন কার্যকলাপের জন্য ইহুদীবিদ্বেষ সারা বিশ্বে বিরাজমান। আর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুসলিমদের সমর্থনের জন্য অন্য রাষ্ট্রগুলোও জেরুজালেম ইস্যুতে ফিলিস্তিনের পক্ষ নিয়েছে।
এক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্বকে এ ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছেন সামরিক দিক দিয়ে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ান। সঠিক সময়ে ওআইসির জরুরি সম্মেলন ডেকে সব মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের একই ছাদের নিচে হাজির করেছেন। আর তার সাহসী বক্তব্য ও দৃঢ়তার কারণে অন্য মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরাও আমেরিকার মত শক্তিশালী দেশের বিপক্ষে সরাসরি অবস্থান নেয়ার প্রেরণা পেয়েছেন।
ট্রাম্প জামাতার সঙ্গে ইসরায়েলের সখ্যতা: ট্রাম্পের জামাতা জারিদ কোশনারের সঙ্গে ইহুদীদের অতি মাখামাখি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরাও ভালো চোখে দেখে না। তারা মনে করছেন জামাতাকে দিয়ে ইসরায়েল ট্রাম্পকে বশীভূত করেছে। এ নিয়ে বিভিন্ন কৌতুকও রয়েছে মার্কিন সমাজে। এছাড়াও ট্রাম্পকে নির্বাচনে জিতিয়ে আনতে ইসরায়েলের ইহুদীরা বিশেষ ভূমিকা পালন করছে বলেও বিভিন্ন গণমাধ্যমে রকমারি খবর প্রকাশ হয়েছে।
জাতিসংঘকে কটাক্ষ করে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য: জাতিসংঘের প্রতি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বিভিন্ন ধরণের উস্কানিমূলক কথা বলেছেন। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘকে মিথ্যার বেসাতি বলে কটূক্তিও করেছেন। এছাড়াও বিভিন্ন সময় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালানোরও অভিযোগ রয়েছে।
ট্রাম্পের সঙ্গে জাতিসংঘের মতপার্থক্য: জাতিসংঘকে অগ্রাহ্য করে ট্রাম্প প্রশাসন বিভিন্ন অমানবিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জাতিসংঘের বিভিন্ন সময় মতপার্থক্য রয়েছে। বিশেষ করে ফিলিস্তিন ইস্যুতে ট্রাম্প এক তরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বিশ্বের ওপর চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন। কারও সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে এমন সিদ্ধান্ত ব্যথিত করেছে মিত্র রাষ্ট্রগুলোকেও। বিষয়টি এভাব চলতে থাকলে ভবিষ্যতে আমেরিকার মতের সঙ্গে বিশ্বের সবার মানিয়ে চলতে হবে-এ ধারণার কারণেও অনেক রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে সরাসরি ভোট দিয়েছেন।
সূত্র: আলজাজিরা, গার্ডিয়ান
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.