চিরনিদ্রায় শায়িত বীরপ্রতীক কাঁকন বিবি

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করতে গিয়ে পাকবাহিনীর হাতে একাধিকবার বন্দি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা কাঁকন বিবি। মুক্তিযুদ্ধে তার এই বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য পরে তাকে বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের লড়াকু এই সৈনিক বুধবার রাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পরে আজ বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্মান জানানো শেষে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় মুক্তিযুদ্ধের এই লড়াকু সৈনিককে ।

আজ বৃহস্পতিবার বিকেল চারটার দিকে কাঁকন বিবির দেশের বাড়ি সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলায় দাফন সম্পন্ন হয়। দোয়ারাবাজারের লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের ক্যাপ্টেন হেলাল-খসরু উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে কাঁকন বিবিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্মান জানানো শেষে মরহুমার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। তার জানাজায় ইমামতি করেন একই উপজেলার সুরিগাঁও গ্রামের মসজিদের ইমাম মাওলানা ইব্রাহিম খলিল। জানাজা শেষে এই মহিয়ষী নারীকে তার নিজ গ্রাম ঝিরাগাঁওয়ে দাফন করা হয়।

বীরপ্রতীক কাঁকন বিবিরি জানাজায় অন্যান্যের মধ্যে অংশ নেন- সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলাম, পুলিশ সুপার মো. বরকতুল্লাহ খান, স্থানীয় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইদ্রিস আলী বীর প্রতীকসহ একাত্তরের বীরসেনানি মুক্তিযোদ্ধারা।

গত সোমবার রাত সাড়ে ৯টায় গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় কাঁকন বিবিকে দোয়ারাবাজার থেকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজে নিয়ে আসা হয়। অবস্থার অবনতি হলে কাঁকন বিবিকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। এই কেবিনেই বুধবার দিবাগত রাত ১০টার দিকে মারা যান এই বীরপ্রতীক। এরপর বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার মরদেহ মেয়ে সকিনার কাছে হস্তান্তর করেন।

এক নজরে কাঁকন বিবি: ভারতের খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে এক খাসিয়া সম্প্রদায়ে জন্ম হয়েছিল কাঁকন বিবির। এরপর মুক্তিযুদ্ধের ঠিক একবছর আগে ১৯৭০ সালে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার শহীদ আলীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। বিয়ের পর নাম পরিবর্তিত হয়ে তিনি হয়ে যান নূরজাহান বেগম।

যুদ্ধের সময় তিনি ফুটফুটে এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হলে তিনি তিনদিন বয়সী কন্যা সকিনাকে রেখে যুদ্ধে চলে যান। যুদ্ধের সময় তিনি মুক্তিবাহিনীর পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করে তথ্য দিতেন। এছাড়াও অংশ নিয়েছেন কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য পরে তাকে বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়।

১৯৭১ সালের জুন মাসে পাকিস্তানি বাহিনী কাঁকন বিবিকে তুলে নিয়ে যান। এরপর পাকিস্তানি ক্যাম্পগুলোতে দিনের পর দিন তার ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। একপর্যায়ে মারাত্মক আহত কাঁকন বিবিকে ছেড়ে দেয় পাকবাহিনী। এরপর সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মীর শওকতের নির্দেশে গুপ্তচর হিসেবে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা শুরু করেন কাঁকন।

তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধারা একাধিক অপারেশনে সফল হন। এক পর্যায়ে আবারো ধরা পড়ে যান কাঁকন। এবার তাঁকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন চালানো হয়। লোহার রড গরম করে ছ্যাঁকা দেয়া হয় শরীরের বিভিন্ন স্থানে। পরে অজ্ঞান অবস্থায় কাঁকনকে মৃত ভেবে পাক বাহিনী ফেলে দেয়। সেখান থেকেও ফিরে আসেন এই যোদ্ধা। এরপর অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ নিয়ে সরাসরি যুদ্ধে নামেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় কাঁকন বিবি প্রায় ২০টি যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।