এ যেনো নতুন সদরঘাট!
- Details
- by এম.এস.আই খান
‘উপরে ফিটফাট ভিতরে সদরঘাট’ -কথাটির সাথে পরিচিত নয় দেশের এমন কোন মানুষ হয়ত পাওয়া যাবে না। বাইরে থেকে সবকিছু স্বাভাবিক মনে হলেও ভিতরে চরম বিশৃঙ্খলা বোঝাতে এ কথাটি মানুষ দীর্ঘ দিন ধরেই ব্যবহার করে আসছে। ছিঁচকে চোর, হকার-কুলিদের হাঁকডাক, টানাটানি, যাত্রীদের তাড়াহুড়ো, লঞ্চ-ইস্টিমারের শব্দ সব মিলিয়ে এখানে যেন হ-য-ব-র-ল অবস্থা। পকেটমার আর সুযোগ সন্ধানী হকার কুলিদের দৌরাত্ম্যে যাত্রীরা ডানে ব্যাগ রেখে বামে তাকাতেই উধাও হয়ে যেত সেই ব্যাগ। তবে বর্তমানে দিন ফিরেছে সদরঘাটের।
ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে প্রায় সহস্র বর্ষ পূর্বে রেল ও সড়ক যোগাযোগবিহীন যে নগরীর পত্তন ঘটেছিল সেই নগরীতে প্রবেশের সদর দরজা ছিল সদরঘাট। ১৬১০ সালে ‘ঢক্কা বৃক্ষবহুল’ এ নগরীকে জাহাঙ্গীরনগর নাম দিয়ে রাজধানী ঘোষণা করেন সুবাদার ইসলাম খান। কিন্তু সে নাম কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। সাধারণ মানুষ এ নগরীকে ঢক্কা বা ঢাকা নামেই ডাকতে থাকে। নদী বিধৌত এ বাংলায় যতো দিন যায় ততোই গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর হতে শুরু করে সদরঘাট। যাতায়াত, পণ্য পরিবহন আর বাণিজ্যিক স্থান হিসেবে সদরঘাট হয়ে যায় অসংখ্য মানুষের জীবন ও জীবিকার উৎস। চলার পথে এখানে মিশে আছে বহু মানুষের অজস্র স্মৃতি ও প্রেম। রচিত হয়েছে গান- ‘যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম, সদরঘাটের পানের খিলি তারে বানাই খাওয়াইতাম...’
কিন্তু কালের বিবর্তনে লোহা-লক্কর আর জঞ্জালের এই ঢাকায় সদরঘাট তার জৌলুশ ধরে রাখতে পারেনি। পৌনে দুই কোটি জনসংখ্যার এই শহরে ধীরে ধীরে সদরঘাট হয়ে উঠলো অসৎ আর দালালদের আড্ডাখানা। সদরঘাট গিয়ে কুলিদের খপ্পরে বা পকেটমারের শিকার হননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর হয়ে উঠলো।
এই কিছুদিন আগেও টার্মিনালের মূর্তিমান আতঙ্ক ছিল ‘কুলি’। সদরঘাটে চব্বিশ ঘণ্টাই হকার-কুলিদের শোরগোল লেগে থাকত। বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬৭ সালে সদরঘাট নৌ-টার্মিনাল নির্মাণ করার পর থেকে টার্মিনালের ইজারার মাধ্যমে কুলি ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হয়ে আসছিল। কুলিদের পরিশ্রমের টাকায় ভাগ বসাত ইজারাদাররা। অন্যদিকে মধ্যস্বত্বভোগী এ ইজারাদারদের যোগসাজশে টার্মিনালে নিয়মিত চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটত। হকার, কুলি, পকেটমারের অত্যাচারে যাত্রীদের নাভিশ্বাস উঠতে শুরু হয়েছিল। এই চরম অরাজকতাপূর্ণ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সুষ্ঠু বন্দর ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নেয় বিআইডব্লিউটিএ। সদরঘাট থেকে অবৈধ কুলি ও হকার উচ্ছেদ করে যাত্রীদের উন্নত ও আধুনিক সেবা প্রদানের লক্ষ্যে টার্মিনালে 'শ্রম যার মজুরি তার' নীতিতে শ্রম ব্যবস্থাপনা চালু করা হয়।
এরপর বিআইডব্লিউটিএ ৮০ জন পোর্টার (কুলি) নিয়োগ করেছে। এই পোর্টারদের কাজ হল চুক্তিভিত্তিক যাত্রীদের লাগেজ ও মালপত্র পরিবহন করা। গত শুক্রবার, ২৯ মার্চ সরেজমিনে যেয়ে দেখা যায় সদরঘাটের প্রধান গেটের পাশের দেয়ালে বড় করে লেখা আছে 'হকারমুক্ত টার্মিনাল'। আকাশি রঙের পোশাক পরে পোর্টাররা সেখানে দায়িত্ব পালন করছে। কোন যাত্রীকে সাহায্য করার প্রয়োজন হলে তারা এগিয়ে যাচ্ছেন।
পোর্টারদের নেতৃত্বদানকারী শাহিন আলম টোয়েন্টিফোর লাইভ নিউজ পেপারকে বলেন, “আমরা প্রতিদিন এখানে শিফটভিত্তিক কাজ করছি। একদল দিনে, আরেক দল রাতে। শুরুতে আমরা ৮১ জনের মত ছিলাম বর্তমানে ৭০-৭৫ জন কাজ করছি। আমাদের নিয়োগ দেয়ার পূর্বে যাত্রীরা কুলিদের হয়রানির শিকার হত। মালামাল বহনের টাকা নিয়েও এখন আগের মত জোর-জবরদস্তি নাই। তারা যা দেয় তা নিয়েই আমরা সন্তুষ্ট থাকি, অনেক সময় আমরাও আগে থেকে বলে (টাকার পরিমাণ) নেই।”
টার্মিনালের যাত্রী হয়রানীর বিষয়ে বরগুনাগামী যাত্রী সাদেক হোসেন (৫০) বলেন, ‘আমি ২০ বছর ধরে ঢাকায় আসা-যাওয়া করি। পূর্বে লঞ্চ থেকে নামলেই কুলিরা এসে সামনে দাঁড়াতো। নিজের মাল নিজে বহন করবো বললেও তাদের হাত থেকে নিস্তার পেতাম না। তাদের দিয়েই মালামাল টানাতে হবে এবং তাদের ইচ্ছেমত টাকা দিতে হবে। মানে অনেকটা মগের মুল্লুকের মত অবস্থা ছিল। বর্তমানে সেই অবস্থা নাই। এখন নীল বাহিনী (পোর্টার) হওয়ার পর তেমন টানাটানি নেই। চাইলে নিজের মালামাল নিজে নিতে পারি। আর না পারলে ওদের ডেকে নেই।’
ঢাকা নদী বন্দর সূত্রে জানা গেছে, ‘যাত্রীদের নিরাপত্তা দিতে সদরঘাট টার্মিনালে ডিএমপি পুলিশ ফাঁড়ি ও নৌ পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়েছে। একই সঙ্গে ৩২ জন আনসার মোতায়েন রয়েছে। লঞ্চঘাটের ১৪টি প্রবেশপথে ৩২টি সিসি ক্যামেরা ও ২২টি মাইক স্থাপন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে পুরো টার্মিনাল মনিটরিং করা হয় এবং মাইকের মাধ্যমে প্রয়োজনে জরুরি ঘোষণা দেওয়া হয়।
মাহমুদা আক্তার নামে বরিশালের এক যাত্রী টোয়েন্টিফোর লাইভ নিউজ পেপারকে বলেন, ‘আগে এখানে দাঁড়াতে ভয় পেতাম। এখানে নেমে ডানে ব্যাগ রেখে ডানে তাকাতেই দেখতাম ব্যাগ নাই। চোর-বাটপার এখন কিছুটা কমেছে। সিসি ক্যামেরা লাগানোতে এখন কিছুটা নিশ্চিন্তে থাকা যায়।’
ঢাকা নদী বন্দরের যুগ্ম পরিচালক এ কে এম আরিফুর রহমান টোয়েন্টিফোর লাইভ নিউজ পেপারকে বলেন, ‘টার্মিনালকে হকারমুক্ত বেশ আগে ঘোষণা করা হলেও তা পুরোপুরি কার্যকর ছিল না। পূর্বে অফিসাররা যখন ভিজিটে যেতেন তখন হকাররা আগে থেকে এক ধরণের বাঁশি ফুঁ দিত এবং সব হকাররা সতর্ক হয়ে লুকিয়ে যেত। ফলে টার্মিনাল হকারদের দৌরাত্ম্য মুক্ত ছিল না। কিন্তু বর্তমানে কোনভাবেই এখানে হকার নেই। শতভাগ হকার মুক্ত। আর পোর্টার (কুলি) নিয়োগ দেয়ার পরে যাত্রীদের হয়রানী কমে গেছে বহু গুণে। টার্মিনাল পূর্বে বিভিন্ন ব্যানার পোস্টারে ভরপুর ছিল এবং পরিবেশ অত্যন্ত নোংরা ছিল। বর্তমানে সে দৃশ্য আমুল পরিবর্তন হয়ে গেছে। নৌ-পুলিশ, পুলিশ ফাঁড়ি, আনসার, পোর্টার এবং সিসি ক্যামেরা চালুর কারণে টার্মিনালে চুরি-ছিনতাই কমে গেছে। যাত্রীরা নিরাপদে চলাচল করতে পারছেন।’
এদিকে ঢাকা সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল হকারমুক্ত করার বিষয়ে নৌ-মন্ত্রী শাজাহান খানও কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। গত ৪ মার্চ তিনি ঘাটের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে হকারমুক্ত করার কাজে অবহেলার জন্য সদরঘাট টার্মিনালে নিয়োজিত পুলিশ, আনসার ও সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন। ফলে যাত্রীরা আগের চেয়ে অনেকটা নিশ্চিন্তে সদরঘাট দিয়ে গন্তব্যে আসা-যাওয়া করতে পারছেন।
বর্তমানে যাত্রী পরিবহনে শৃঙ্খলা আনার জন্য টার্মিনালে জেলাভিত্তিক ঘাট রয়েছে। ঝালকাঠি, বরিশাল ও বরগুনার যাত্রীদের জন্য পুরনো, নতুন ও হাইস্পিড ঘাট নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। ওয়াইজঘাট দিয়ে যাতায়াত করেন পটুয়াখালী ও গলাচিপার যাত্রীরা। আর লালকুঠিরঘাট দিয়ে চলাচল করেন চাঁদপুরসহ কাছের জেলার যাত্রীরা। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর অংশ হিসেবে ৩৫টি আধুনিক টিকিট কাউন্টার নির্মাণ করা হয়েছে একই সঙ্গে নতুন ভবনের দোতলায় যাত্রীদের বসার জন্য বিশাল ওয়েটিং স্পেস রাখা হয়েছে।
লঞ্চ চলাচল ছাড়াও স্টিমারে করে বিভিন্ন মালামাল ও শাকসবজি পরিবহন করা হয় এ ঘাট দিয়ে। ফলে ঘাটকে কেন্দ্র করে ফলমূল, শাকসবজি ও বিবিধ সামগ্রীর একটি বৃহৎ বাজার গড়ে ওঠেছে। লঞ্চ-স্টিমার ছাড়াও এখানকার তিনটি নৌকাঘাট দিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীর এপার-ওপার খেয়া পারাপার করা হয়।
দ্রুতগতির বাস পরিবহনের এই যুগেও পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, ঝালকাঠি, মাদারীপুর, চাঁদপুর, খুলনা, হাতিয়া, বাগেরহাটসহ দক্ষিণাঞ্চলের ২২ জেলার মোট ৪৫টি নৌ-রুটে প্রতিদিন গড়ে ৮০ হাজার যাত্রী যাওয়া-আসা করেন। ঈদসহ বিশেষ উৎসব উপলক্ষে এ সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। সদরঘাটের ২৪টি পন্টুন ও ১৪টি গ্যাংওয়ে দিয়ে দুই ঈদে প্রায় ৪০ লাখ যাত্রী যাতায়াত করেন। প্রমোদতরীর মতো অভিজাত লঞ্চগুলোতে যাতায়াতে থাকে গৃহের প্রশান্তি। এ কারণে সড়কপথে জ্যাম ও ক্লান্তিকর ভ্রমণের পরিবর্তে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ যাতায়াত মাধ্যম হিসেবে এখনো নৌপথকেই বেছে নেন।
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.