আপনি পড়ছেন

ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর উগ্র হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দিন দিন। আর তারই অংশ হিসেবে কৃষকের উপর গো-রক্ষা নীতি চাপিয়ে দেয়া হয়েছে ধর্মের দোহাই দিয়ে। এ নীতির মাধ্যমে গরু বিক্রি কিংবা জবাই করা নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। উগ্র হিন্দুত্ববাদী কিছু সংগঠনের কথা মত চলতে গিয়ে মোদী সরকার যেন প্রমাণ করতে বসেছে- ‘গরুর চেয়ে নহে কিছু মহীয়ান!’

indian cow

গো-রক্ষার নামে কৃষক এবং ভিন্ন ধর্মের ওপর বিশেষ করে মুসলিমদের ওপর যে বিধি নিষিধ আরোপ করা হয়েছে, তা যেন মধ্যযুগে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ভারতকে। এ নিয়ে গোটা ভারতজুড়ে চলছে অরাজকতা। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, মানুষের জীবনের চাইতে একটি গরুর মূল্য ও মর্যাদা অনেক বেশি।

জানা যায়, ২০১৪ সালে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর গোহত্যা বন্ধ করার দাবিতে তৎপর হয়ে ওঠে কট্টরবাদী সংগঠনগুলো। তাদের কথামত সরকারও গোরক্ষা নীতিমালা প্রণয়ন করে। আর এরপর থেকে গোটা ভারতজুড়ে গরু ব্যবসায়ীদের ওপর নেমে আসে জোর-জুুলুম। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ২০১৭ সালের মে মাসে ‘গোহত্যা বন্ধে সরকারি নীতিমালা’ স্থগিত রাখতে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট রায় দিলেও কার্যত তা কোন কাজে আসেনি।

ঘোষিত কিংবা অঘোষিতভাবে বিভিন্ন রাজ্যে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে গরু ব্যবসা। এখানেই শেষ নয়, গরু নিয়ে কোন কৃষক রাস্তায় চলাচল করাও দায় হয়ে পড়েছে। নিতান্তই রাস্তায় চলতে চাইলে সঙ্গে নিতে হবে গোরক্ষা কর্তৃপক্ষের সনদ! সনদ পেতে কৃষককে মুচলেকা দিতে হবে- ‘জবাই বা খাওয়ার উদ্দেশ্যে বা বিক্রি করার জন্য এই গরু নেওয়া হচ্ছে না’।

পূর্বে কৃষকরা বাড়তি আয়ের আশায় গরু পালন করত। দুধ দেয়া বন্ধ হলে গরু বিক্রি করেও অর্থ পেত তারা। কিন্তু সরকারের এই অবিবেচক আইনের ফলে দুধ দেওয়ার ক্ষমতা হারানো বয়স্ক গাভি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন হাজার হাজার কৃষক ও খামারিরা।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, মধ্যপ্রদেশে প্রায় দুই কোটি গরু রয়েছে। সেখানকার জনসংখ্যা অনুপাতে গড়ে প্রতি তিনজন মানুষের জন্য একটা গরু আছে। এসব গরুর অর্ধেকেরও বেশি এখন কৃষকের কোন উপকারে আসছে না। কিন্তু সরকারের জোরজবরদস্তি আইনের কারণে কৃষকরা এসব অনুৎপাদনশীল বলদ ও গাভী বিক্রি করতে পারছেন না।

উল্টো গরুর খাদ্য জোগাতে খরচ গুনতে হচ্ছে। অভাবী কৃষকরা এখন গরুর খাদ্য জোগাড় করতে যেয়ে নিজেরা উপোস থাকছেন। নিরুপায় হয়ে অনেকেই রাস্তায় পালিত গরু ছেড়ে দিয়ে কেটে পড়ছেন। মালিকবিহীন এসব গরু পেটের ক্ষুধায় ঢুকে পড়ছে অন্য কৃষকের শস্য ক্ষেতে। এতে খাওয়ার চেয়ে তিনগুণ শস্য নষ্ট হচ্ছে। ক্ষেতের ফসল নষ্ট হওয়ায় ধার-দেনা করে চাষীর কপালে উঠছে হাত।

গত ডিসেম্বরে উত্তর প্রদেশের বুন্দেলখন্ডের স্থানীয় একটি কলেজ থেকে বিনামূল্যে গরুর খাবার দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিলো। মোটামুটি ৩০০ গরুকে খাওয়ানোর বন্দোবস্ত করেছিল কলেজ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বিনামূল্যে খাবার খাওয়ানোর ঘোষণা শুনে সাত হাজার গরু নিয়ে উপস্থিত হন খামারিরা! আরো ১৫ হাজার গরু কলেজের দিকে আসতে শুরু করলে শুরু হয়ে যায় শোরগোল। পরে খামারিদের ফেরত পাঠাতে লাঠিপেটা শুরু করে কলেজ কর্মচারীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অ্যাকশনে নামে পুলিশ প্রশাসনও। হুড়োহুড়ির আর লাঠিপেটার ঝামেলায় পায়ের নিচে পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায় কয়েকজন। বিনামূল্যে গরুর খাবার বিতরণের দিন খাবার না পেয়ে গরু ফেলে চলে যান খামারিরা।

cows

এই চরম বিশৃঙ্খলার পর আত্মহত্যা করে বসেন স্থানীয় এক কৃষক। ফেলে যাওয়া গরু হতভাগ্য ওই কৃষকের জমিতে ‍ঢুকে তার সব ফসল নষ্ট করে ফেলে। নগদ অর্থ না থাকায় দুই লাখ রুপি ধার করে ফসল বুনেছিলেন তিনি। সেই ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আসন্ন খাবার সংকট আর ঋণ পরিশোধ করার কোন উপায়ন্তর না পেয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি।

এদিকে মালিক ছাড়া গরুর চিন্তায় ঘুম নেই কৃষকের। ইন্ডিয়া টুডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মধ্যপ্রদেশের ভূপাল জেলার থান্ডা গ্রামের নিরুপায় কৃষক কৈলাস নায়েক সাত মাস ধরে ঘরবাড়ি ছেড়ে নিজের গম ক্ষেতে বসবাস শুরু করেছেন। মুহূর্তের বেখেয়ালে লাগামছাড়া গরু হানা দিতে পারে ফসলের ক্ষেতে। তাহলে সারা বছর থাকতে হবে অনাহারে। শুধু কৈলাস নয় গরুর দুশ্চিন্তায় এখন ঘুম হারাম লাখো কৃষকের।

গরুর হামলায় শুধু ফসল নষ্টই নয়, ধ্বস নামতে শুরু করেছে মাংস ও চামড়া শিল্পে। জানা গেছে, কৃষক মেরে সরকারের গোরক্ষার নীতি বহাল রাখার ফলে মাংস রপ্তানিতে এখন আর বিশ্বে প্রথম নেই ভারত। দেশটির এই অবস্থান দখলে নিয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিল।

সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো জানিয়েছে, গোরক্ষা নীতি চালুর পর থেকে ভারতের মাংস ও চামড়া রপ্তানির পরিমাণ অর্ধেকের বেশি হ্রাস পেয়েছে। বোতাম, টুথপেস্ট, রঙের ব্রাশ, পশুর ওষুধসহ অনেক শিল্প এখন ক্ষতির সম্মুখীন। এছাড়া যেসব পন্য উৎপাদনের মূল উপাদান হিসেবে পশুর হাড়ের ব্যবহার করা হয়, সেসব শিল্প প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হওয়ার প্রহর গুনছে।

এতকিছুর পরেও টনক নড়েনি নরেন্দ্র মোদী সরকারের। অযৌক্তিক নীতিকে প্রতিষ্ঠিত করতে গোরক্ষা নীতিমালা থেকে সরে আসেনি বিজেপি। কট্টরপন্থীদের পরামর্শে তারা এখন নজর দিয়েছে গোশালা তৈরিতে! ঋণের দায়ে কৃষক মরতে শুরু করলেও ভারতের রাজ্য সরকারগুলো কেন্দ্রকে খুশি করতে কোটি কোটি রুপি বরাদ্দ দিচ্ছে গোশালা তৈরিতে।

দেশটির বিভিন্ন প্রদেশে এরই মধ্যে পাঁচ হাজার গোশালা তৈরি হয়েছে। আরো অসংখ্য তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন স্থানে। উত্তর ভারতের বিজেপি-শাসিত রাজ্য সরকারের বাজেটের বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে গরুর কল্যাণে। এমনকি বেসরকারি উদ্যোগেও গোশালা তৈরিতে অর্থ নেয়া হচ্ছে। ২০১৪ সালের আগে যেসব কোম্পানি গোরক্ষায় ভূমিকা রাখেনি, তারাও সরকারকে খুশি করতে গোরক্ষা তহবিলে অর্থ দিচ্ছে। টাটা পাওয়ার ও আলেম্বিক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির মত প্রতিষ্ঠিত বড় বড় কোম্পানীগুলো এখন গরুর কল্যাণে দান করছে!

কট্টরপন্থীরা এতসব এলাহী কাণ্ড ঘটানোর পরেও গরু বাঁচানো যাচ্ছে না! কারণ গোশালাগুলো মারাত্মক নোংরা হওয়ায় দূষিত পরিবেশে গরু মারা যাচ্ছে। আর এরই মধ্যে সার্বিক পরিস্থিতি দেখে মধ্যপ্রদেশের বিরোধী দলের নেতা অজিত সিং মন্তব্য করেছেন, ‘গো রক্ষার নামে বিজেপি সরকার ভণ্ডামি শুরু করেছে’।

ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গোশালাগুলোর অবস্থা এখন কসাইখানার চেয়েও খারাপ। অস্বস্তিকর পরিবেশের কারণে এখানে যে পরিমাণ গরু মারা যাচ্ছে, কোনো কসাইখানাতেও এতটা মারা হয় না। গত ডিসেম্বরে ভারতের নারী ও শিশু উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রী মানেকা গান্ধী বলেন, ‘বিশ্বের অনন্য দেশে অর্থকরী মূল্যহীন গরু মেরে ফেলা হয়। ভারতে গরু মারা হয় না, তবে ‘অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে’ রাখা হচ্ছে! যা মেরে ফেলার চাইতেও ভয়াবহ। খামারিরা পালতে না পেরে গরু ছেড়ে দিচ্ছেন। এগুলো কৃষকের ফসল নষ্ট করছে।’

গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, গত সেপ্টেম্বর মাসে মধ্যপ্রদেশে ৪৭২ হেক্টর জমির ওপর ৩২ কোটি রুপি ব্যয়ে তৈরি হয় দেশের প্রথম ‘কামধেনু আশ্রম’। এই আশ্রম প্রতিষ্ঠার মাত্র এক মাসের মাথায় পলিথিন খেয়ে মারা যায় ১০০ গরু। অন্যদিকে জয়পুরে অনুরূপ একটি সরকারি গোশালায় মাত্র ১০ দিনের মধ্যেই মারা গেছে ৫০০ গরু। পিপলস ইউনিয়ন ফর ডেমোক্রেটিক রাইটস (পিইউডিআর) নামে একটি সংগঠনের প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতে ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত গোরক্ষার নামে ১৩৭টি বাড়াবাড়ির ঘটনা ঘটেছে। এতে অন্তত ২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।

Get the latest world news from our trusted sources. Our coverage spans across continents and covers politics, business, science, technology, health, and entertainment. Stay informed with breaking news, insightful analysis, and in-depth reporting on the issues that shape our world.

360-degree view of the world's latest news with our comprehensive coverage. From local stories to global events, we bring you the news you need to stay informed and engaged in today's fast-paced world.

Never miss a beat with our up-to-the-minute coverage of the world's latest news. Our team of expert journalists and analysts provides in-depth reporting and insightful commentary on the issues that matter most.