তবুও বিকল্প নেই ইলিশের

পহেলা বৈশাখের সকালের মেনুতে ইলিশ রাখার প্রথাকে 'কৃত্রিম' আখ্যা দিয়ে এর বিরুদ্ধে গত কয়েক বছর ধরে জোরেশোরে প্রচারণা চলছে। কিন্তু এ বছরও শহুরে বাসিন্দাদের মাঝে সুস্বাদু ইলিশের ব্যাপক চাহিদা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যার ফলে বাংলা নতুন বছরকে সামনে রেখে ইলিশের দাম লাগামহীনভাবে বেড়ে চলেছে। তারপরও পহেলা বৈশাখের আগের মাছের বাজারে ইলিশের কোনো বিকল্প নেই।

রাজধানীর বিভিন্ন কাঁচাবাজারের মাছ ব্যবসায়ীদের সাথে বৃহস্পতি ও শুক্রবার কথা বললে তারা ইউএনবিকে জানান, পহেলা বৈশাখের এক সপ্তাহ আগে থেকেই অনেক ইলিশ ক্রেতার আনাগোনা শুরু হয়েছে, যা দামকে উড়ন্ত অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে।

ক্রেতারা জানান, উৎসব উপলক্ষে দাম আরো বেড়ে যেতে পারে, এমন ভয় থেকে তারা পহেলা বৈশাখ উদযাপনে আগেভাগে ইলিশ কিনে রাখছেন।

ইউএনবির সাথে আলাপকালে প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও লেখক ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, কিছু শহুরে লোক পহেলা বৈশাখের সকালে পান্তা ভাতের সাথে ইলিশ খাওয়া চালু করেছিলেন। যার সাথে দেশের দীর্ঘদিনের প্রথা ও ঐতিহ্যের সত্যিকারের সম্পর্ক নেই।

তারা বলেন, জাতীয় মাছ ইলিশের প্রজনন মৌসুমে একে রক্ষা করতে মানুষ যাতে কৃত্তিম পান্তা-ইলিশ সংস্কৃতিতে আগ্রহী না হয় সে জন্য গণমাধ্যম ও সরকারকে ব্যাপক প্রচারাভিযান চালাতে হবে। সেই সাথে যেসব সিন্ডিকেট উৎসব উপলক্ষে দাম বাড়িয়ে বিপুল অর্থ কামিয়ে নেয় তাদের ভেঙে দিতে হবে।

মালিবাগ বাজারে আসা তাসমিন সুলতানা নামে এক গৃহিণী ইউএনবিকে বলেন, 'পহেলা বৈশাখের সকালে আমার মেয়ের কয়েকজন বন্ধু পান্তা-ইলিশ খেতে বাসায় আসবে। তাই ইলিশ কিনছি। আমি অন্য খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করতে মেয়েকে বুঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সে জেদ ধরে আছে।'

রাজধানীর কারওয়ানবাজার, শান্তিনগর, মালিবাগ, সেগুনবাগিচা ও রামপুরা কাঁচাবাজারের মাছ ব্যবসায়ীরা জানান, পহেলা বৈশাখের চাহিদার কারণে এক সপ্তাহের ব্যবধানে মাঝারি ও বড় ইলিশের দাম প্রতি কেজিতে ২৫০ থেকে ৪০০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে।

পহেলা বৈশাখ যত এগিয়ে আসবে ইলিশের দাম তত বৃদ্ধি পাবে বলে জানান তারা।

বড় আকারের ইলিশ ১৬শ’ থেকে ১৮শ’ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। আর ব্যবসায়ীরাও সরবরাহে ঘাটতি দেখাতে ধনী লোকদের জন্য কয়েকটি করে ইলিশ ডালায় সাজিয়ে রাখছেন।

৮০০ গ্রাম ওজনের একটি ইলিশ ৯শ’ থেকে ১৫শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে ৬০০ থেকে ৭০০ গ্রামেরগুলো ৮শ’ থেকে সাড়ে ৯শ’ এবং ৪০০-৫০০ গ্রামেরগুলো সাড়ে ৫শ’ থেকে ৭শ’ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।

এছাড়া ইলিশগুলোকে যদি পদ্মার বলে চালানো যায় তাহলে দামও পাওয়া যাচ্ছে অনেক বেশি।

শুক্রবার কারওয়ানবাজার কাঁচাবাজারে আসা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা সেলিম ভূঁইয়া ইউএনবিকে বলেন, ‘পহেলা বৈশাখের সকালে খাওয়ার জন্য স্ত্রী ও সন্তানরা ইলিশ কেনার আবদার করেছে। তাই আগেভাগে কিনে ফেলছি। ইলিশের দাম এখন অনেক বেশি, আর আমার মনে হয় কয়েকদিন পর দাম আরো বাড়বে।’

সেখানকার মাছ ব্যবসায়ী আবুল বাশার বলেন, পহেলা বৈশাখ পালনে এখনো আট দিন বাকি থাকলেও ইলিশ কিনতে মানুষের ভিড় বাড়ছে।

তবে তিনি দাবি করেন, ইলিশ বিক্রি থেকে তারা যৌক্তিক পর্যায়ের লাভ রাখছেন। ‘বিপুল চাহিদার কারণে আমাদের অধিক দাম দিয়ে ইলিশ সংগ্রহ করতে হচ্ছে। তাই ভালো লাভ করতে পারছি না।’

শান্তিনগর বাজারের আরেক মাছ ব্যবসায়ী আবুল কালাম বলেন, দুই-তিন দিন পরে ইলিশের দাম আরো বাড়বে। কারণ ধনী ও মধ্যবিত্ত মানুষেরা পহেলা বৈশাখের এক-দুই দিন আগে ইলিশ কিনতে আসেন।

এবিষয়ে যোগাযোগ করা হলে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়া মধ্য ও উচ্চ-মধ্যবিত্তদের বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয়। যদিও বাংলা নতুন বছর উদযাপনের পুরোনো ঐতিহ্যের সাথে এর কোনো সংযোগ নেই। ‘আমার মনে হয়, যারা পহেলা বৈশাখে উৎসবমুখরভাবে পান্তা-ইলিশ খায় তারা আমাদের সত্যিকারের সংস্কৃতির সাথে তামাশা করে।’

এরকম ‘সাজানো’ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রচার নিয়ে তিনি বলেন, পহেলা বৈশাখ পালনে মানুষকে পান্তা-ইলিশ থেকে বের করে আনতে বৈশাখী মেলা, যাদু ও সার্কাস শো এবং গানের আয়োজনের মতো ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানগুলো জনপ্রিয় করতে হবে। 

অন্যদিকে রামেন্দু মজুমদার বলেন, বৈশাখ উদযাপনে পান্তা-ইলিশ খাওয়া নতুন উদ্ভাবিত সংস্কৃতি। ‘এক শ্রেণির লোক পহেলা বৈশাখে ফ্যাশন হিসেবে পান্তা-ইলিশ খেয়ে এক দিনের জন্য বাঙালি হওয়ার চেষ্টা করে।’

সেই সাথে পহেলা বৈশাখে শহুরে এলাকায় ইলিশের বিশাল চহিদার কারণে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী বিপুল পরিমাণ মুনাফা করে নেয় বলে জানান এই বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।

তিনি আরো বলেন, এই কৃত্তিম সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে এবং প্রজনন মৌসুমে ইলিশ রক্ষায় গণমাধ্যমকে বিষয়টির ওপর জোর দিতে হবে।

আবদুর রহমান জাহাঙ্গীর ও জুনায়েদ শিশির, ইউএনবি।