চকবাজারের ইফতার হাট: কয়েক শতাব্দির ইতিহাস
- Details
- by এম.এস.আই খান
ভোজন বিলাসিতার জন্য মুঘলদের বিশেষ খ্যাতি আছে। বর্তমানে চলন-বলন, পোশাক-আশাক থেকে শুরু করে খাদ্যাভ্যাস, সব কিছুতেই ইউরোপীয় অনুকরণ চললেও সম্রাট শাহজাহান ও মমতাজ মহলের বিবাহ উপলক্ষে যে ভোজের আয়োজন হয়েছিল তা দেখে ইউরোপীয়রা পর্যন্ত অবাক হয়েছিলেন। মুঘলদের রসনা বিলাসের খ্যাতি তাই বিশ্ব নন্দিত।
মুঘলদের সেই রন্ধনশিল্প ঢাকায় এসেছিল স্থানীয় নবাবদের কল্যাণে। আর রাজকীয় সে খাবারের সঙ্গে আম-জনতার পরিচয় ঘটে চকবাজারের কল্যাণে। চকবাজারে মুঘল আমলের ঐতিহ্যের ছাপ ও ছোঁয়ায় তৈরি রকমারি ইফতার বিক্রি জমজমাট হতে শুরু করে উনবিংশ শতাব্দিতে। কালক্রমে মুঘলাই খাবার ও বাহারি ইফতার আয়োজন ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়লেও পুরান ঢাকার চকবাজারের ঐতিহ্য অতিক্রম করতে পারেনি কেউ।
'ঢাকা: স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরী' বইয়ে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন উল্লেখ করেছেন, ‘চক পরিচিত ছিল পুরোনো ‘নাখাস’ নামে। আরবি ‘নাখাস’ অর্থ ‘দাস বিক্রেতা’। এ থেকে অনুমান করা যায় যে, মুঘল আমলে চকবাজার দাস-বিক্রির কেন্দ্র হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছিল। শুধু তাই নয় অবসর বিনোদন, আড্ডা দেওয়া বা সময় কাটাবার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল চক।’ তবে ইফতার বাজার গড়ে ওঠার বিষয়ে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন টোয়েন্টিফোর লাইভ নিউজপেপারকেবলেন, 'অনুমান করা হয়, উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে এখানে ইফতারি বাজার জমজমাট হতে শুরু করে।'
অপর ঐতিহাসিক নাজির হোসেন তার ‘কিংবদন্তির ঢাকা’ বইয়ে লিখেছেন, রোজার সময় মুঘলাই খাবার এবং রকমারি ইফতার বিক্রি করা হতো এখানে। ১৮৫৭ সালের আগেই চকবাজারের ইফতার হাট জমজমাট হয়ে ওঠে। সে সময় থেকেই চকবাজারে গড়ে ওঠতে থাকে নানা রকম মুখরোচক খাবারের দোকান।
ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত ১৯০৪ সালের চকবাজার, আলোকচিত্রী: ফ্রিজ ক্যাপ
একালের চকবাজার: মুঘল আমল থেকে রমনা যেমন ছিল একটি অভিজাত এলাকা, তেমন চকবাজার ছিল একটি ব্যবসাকেন্দ্র। আজ ৪০০ বছর পরও এলাকা দু’টির মর্যাদা একই রকম রয়ে গেছে। আর জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে এখানে বেড়েছে ভিড়, বেড়েছে ব্যস্ততা। কাপড়, কসমেটিক্সসহ বিভিন্ন ধরণের পাইকারি মালামাল বিক্রির জন্য চকের জুড়ি নেই। তবে চকবাজার এখনো সুখ্যাতি বহন করছে তার ঐতিহ্যবাহী ইফতার হাটের জন্য। ১৬৭৬ সালে তিন গম্বুজঅলা চকবাজার শাহী মসজিদ নামে শায়েস্তা খাঁ যে মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন সে মসজিদের সামনের রাস্তায় বসে এই ইফতার হাট।
প্রতি রমজানে দুপুরের পর থেকেই এখানে ইফতার কিনতে আসা মানুষের ভিড় বাড়তে শুরু করে। চকের বাতাসে ভাসতে থাকে নানা স্বাদের আর নানা পদের মুখরোচক খাবারের মনকাড়া সুবাস। এখানে পাওয়া যায় ছোট কোয়েলের কাবাব থেকে আস্ত খাসি, গরু কিংবা খাসির মাংসের সুতি কাবাব, আধা কেজি থেকে পাঁচ কেজি ওজনের শাহী জিলাপি ও খেজুর থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের ফলমূল। এছাড়াও চিকেন টোস্ট, চিকেন টিক্কা, চিকেন রোল, খাসির রোস্ট, মোরগ মোসাল্লাম, কিমা পরোটা, হালিম, বিরিয়ানি, ঘুমনি, আলুর চপ, পিঁয়াজু, বেগুনি, ছোলা বুট, ডিম চপ, পাকুড়া, মিষ্টি দই, ঝাল-টক দই বড়া, বিভিন্ন রকমের আচার ও মাঠাসহ নানা ধরনের মুখরোচক পানীয় কিনতে পাওয়া যায়।
বড় বাপের পোলায় খায়: চকবাজারে ঢুকলে প্রথমেই যে শব্দটি কানা আসে তা হল- 'বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙায় ভইরা লিয়া যায়'! পুরান ঢাকায় এমনও পরিবার আছে, যাদের চকবাজারের খাবার ছাড়া ইফতার অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এ বিষয়ে লেখক আবু যোহা নূর আহমদ বিশ শতকের তৃতীয় দশকে চকের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন- ‘প্রথম রোজার ইফতারীর জন্য আপন ঘরের তৈয়ারি বহুবিধ খাবার থাকা সত্ত্বেও অনেকেই চকবাজারের দিকে ছুটিত।’
পুরান ঢাকায় কিংবদন্তি আছে, বড় বাপের পোলায় খায় খাবারটি প্রায় শত বছরের পুরানো। তবে মো: সালেকিন নামে খাবারটির একজন বিক্রেতা দাবি করেন তার দাদা কামেল মহাজন এই খাবারটি আবিষ্কার করেছেন। তিনি বলেন, আমার দাদার পরে বাবা এবং তাঁর পরে এখন আমি বিক্রি করছি। তিন পুরুষ ধরে আমরা খাবারটি বিক্রি করে আসছি।
বড় বাপের পোলায় খায় টোঙ্গায় ভরছেন বিক্রেতা
একটি বড় গামলায় গরুর মগজ, গরুর কলিজা, সুতি কাবাব, মাংসের কিমা, খাসির মাংস, মুরগির মাংসের কুচি, মুরগির গিলা কলিজা, ডিম, আলু, ঘি, কাঁচা ও শুকনো মরিচ, চিড়া, ডাবলি, বুটের ডাল, মিষ্টি কুমড়াসহ ১৫ পদের খাবার ও ১২ ধরনের মসলা নিয়ে দুই হাতে ভালোভাবে মাখিয়ে যে মিশ্রণ তৈরি হয়, তার নামই ‘বড় বাপের পোলায় খায়’। এ মিশ্রণটিই ঠোঙায় ভরে কেজি দরে বিক্রি করা হয়। এ বছর খাবারটি ৪৫০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। ছোট-বড় সব বয়সী মানুষের মধ্যে এটি কিনতে রীতিমতো কাড়াকাড়ি লেগে যায়। শুধুমাত্র এই খাবারটি কিনতে বিভিন্ন এলাকা থেকে এখনো ক্রেতারা চকবাজারে ছুটে আসেন।
নানা রকমের কাবাব: চকে গরুর মাংসের এবং খাসির মাংসের শাহী সুতি কাবাব বেশ জনপ্রিয়। লোহার শিকে ঝোলানো সুতি কাবাব বিক্রি হয় প্রতি কেজি ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত। এর মধ্যে খাসির মাংসে তৈরি সুতি কাবাব ৭০০ টাকা কেজি ও গরুর সুতি কাবাব ৫০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও পাওয়া যায় রেশমি কাবাব, সুতি কাবাব, জালি কাবাব, বটি কাবাব, কাঠি কাবাব ও আস্ত মোরগের কাবাব।
লোহার শিকে কাবাব ঝুলিয়ে বিক্রি করছেন হাজী নূর হোসেন
কাবাব বিক্রেতা হাজী নূর হোসেন জানান, মশলা ও বিভিন্ন উপকরণের দাম বেশি থাকায় গত বছরের চাইতে এ বছর কাবাবের দাম ৫০ টাকা বেশি। প্রায় ৬০ বছর ধরে চকে কাবাব বিক্রি করেন শাহ মোহাম্মাদ আলী হোসেন। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পত্রিকায় তার কাবাব নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও ছবি দেখিয়ে টোয়েন্টিফোর লাইভ নিউজপেপারকে তিনি বলেন, পাকিস্তান আমল থেকে আমি কাবাব বিক্রি করে আসছি। এক সময় আমার দোকান ছিল। দোকান বেহাত হয়ে যাওয়ার পরও আমি এ ব্যবসা ছাড়ি নাই। এখন ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বিক্রি করি।
হরেক রকম জিলাপী: একটি জিলাপী এক কেজি থেকে পাঁচ কেজি পর্যন্ত ওজন, নাম শাহী জিলাপী। চকের জিলাপী বিক্রেতা নাজিমুদ্দিন জানান, শাহী জিলাপী ছাড়াও তারা রেশমি জিলাপি, মুম্বাই জিলাপী ও নরমাল জিলাপী বিক্রি করেন। তবে সবচেয়ে বেশি দাম মাশকালাইয়ের শাহী জিলাপীর। এ বছর যার কেজি বিক্রি করছেন ২০০ টাকা।
ডুবো তেলে ভাজা হচ্ছে শাহী জিলাপী
বাহারী পরোটা: খাসির কিমা পরোটা, গরুর কিমা পরোটা, মুরগির কিমা পরোটা আর প্লেইন কিমা পরোটা পাওয়া যায় এখানে। মো: খোকন নামে একজন বিক্রেতাকে দেখা গেল ৪০ টাকা থেকে ৮০টাকার মধ্যে বিক্রি করছেন এসব পরোটা।
চকে মাংসের সাথে বিক্রি হচ্ছে কিমা পরোটা
কলিজা ঠাণ্ডা করা পানীয়: বোরহানী, লাবাং, ফালুদা, মাঠা, পনির ও পেস্তা বাদামের শরবতসহ বিভিন্ন ধরণের মুখরোচক পানীয় বিক্রি হয় এখানে। এর মধ্যে বোরহানী, লাবাং, ফালুদা বোতলের সাইজ হিসেবে বিভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে। আর মাঠা বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা কেজিতে। আর এক কেজি পনির পাওয়া যাচ্ছে ৫৫০ থেকে ৬০০টাকায়।
১৫ বছর ধরে প্রতি রমজানে শরবত বিক্রি করে আসছেন মো. নাসির
জিভে জল আনে আচার: টক, ঝাল ও মিষ্টি নানা স্বাদের আর নানা নামের আচারের পসরা বসে এখানে। ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চকে আচার বিক্রি করে আসছেন দ্বীন মোহাম্মাদ। টোয়েন্টিফোর লাইভ নিউজপেপারকে তিনি জানালেন, জলপাই, আম, বরই, রসুন, আমলকিসহ বিভিন্ন ধরণের আচার বিক্রি করেন তিনি। বিভিন্ন সাইজের কৌটায় ভরে ১০০ থেকে শুরু করে ৪০০টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি করছেন তিনি।
ষাটোর্ধ দ্বীন মোহাম্মাদ রমজানে আচার বিক্রি করেন চকে, বাকি ১১ মাস অন্যস্থানে
বসে ফলের বাজার: নবাবী খাবারই নয় এখানে বিক্রি হয় মৌসুমি ফলও। আম, লিচু, কলা, পেয়ারা, তরমুজ, খেজুর, আনারস, মাখনা, জামরুলসহ বিভিন্ন রকমের মৌসুমি ফলও পাওয়া যায় চক বাজারের শাহী মসজিদের সামনে। অনেকেই এখান থেকে ফল কিনে নিয়ে বাসায় জুস তৈরি করে ইফতারে পরিবেশন করেন। এখানকার ইফতার কিনতে দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন ছোট-বড় নানা বয়সী মানুষ। প্রতিদিন বিকেলে চকবাজার পরিণত হয় ইফতার উৎসবে।
মতিঝিল থেকে চকে ইফতার কিনতে যাওয়া আজিম শেখ টোয়েন্টিফোর লাইভ নিউজপেপারকে বলেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় ইফতার বিক্রি হলেও চকের ইফতার বাজারের মত এতটা জমজমাট আর কোথাও হয় না। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এখানকার ইফতার বাজার দেখতেও অনেক সময় এখানে ছুটে আসি। যাবার সময় হাতে করে দু-একটা আইটেম নিয়ে যাই। পরিবারের সবাই খুশি হয়।’
ঐতিহ্যের খাবারে মানের প্রশ্ন: পুরান ঢাকার চকের ইফতার বাজার এক ঐতিহ্যের নাম, রয়েছে স্বতন্ত্র ইতিহাস ও দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার গৌরবও। মুঘল শাসন শেষে ব্রিটিশ কর্তৃত্ব, তারপর পাকিস্তানের শাসন-শোষণ পেরিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ। এই সুদীর্ঘ সময়ে এই ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে শত ঘটনা শত সংগ্রাম। তবুও প্রতি বছর রমজানে রসনা বিলাসী মুসল্লিদের জন্য নবাবী আয়োজনে একটুও ভাটা পড়েনি। আজও সগৌরবে ভোজন রসিকদের জন্য বসে জমজমাট চকবাজারের ইফতার বাজার।
তবে ঐতিহ্যবাহী এ ইফতার বাজারের ইতিহাস যতটা পুরনো, দিনে দিনে এখানকার খাবারের মান যেন ততটাই অস্বাস্থ্যকর হয়ে যাচ্ছে। জানা গেছে, ভোর রাত থেকেই শুরু হয়ে যায় পুরান ঢাকার বিখ্যাত খাবার আইটেমগুলো তৈরির কাজ। বেলা ১১টার দিকে সাজানো শুরু হয় দোকান, একটার পর জমজমাট হতে শুরু করে ইফতার বাজার। বিক্রি চলে সন্ধ্যার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত। এই দীর্ঘ সময় খোলা অবস্থায় রেখে বিক্রি করায় ধুলোবালি গড়ায় খাবারের গায়ে।
আর খাবার বিক্রেতাদের হাতে থাকে না কোন গ্লাভস। ফলে সূর্যতাপে আর গরমে ঘেমে হাতের জল গড়ায় খাবারে। অন্যদিকে রোদে বা ধূলায় খাবারের রং বিবর্ণ হয়ে এলে তেল ছিটিয়ে করা হয় চকচকে। তাজা মনে করে ক্রেতারা এই খাবার গ্রহণ করেন সানন্দে। ক্রেতারা জানিয়েছেন, এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশন পদ্ধতি দেখেও শুধুমাত্র ঐতিহ্য ও নামের কারণে তারা খাবারটি কিনে নেন। সিটি কর্পোরেশন বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চকের ইফতার বিক্রেতা ও প্রস্তুতকারকদের সচেতন ও প্রশিক্ষণ দিলে ঐতিহ্যের খাবারের সঙ্গে যুক্ত হবে মান। ভোক্তারাও নিশ্চিন্তে খানদানি খাবার খেয়ে প্রশংসায় ফিরে যাবেন মুঘল দরবারে।
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.