ফিরে দেখা ১৯৯৮ বিশ্বকাপ: জিদান জাদুতে ফ্রান্সের রূপকথা

ছবি ও কবিতার দেশ ফ্রান্স। দুই দশক আগে কিংবদন্তি ফুটবলারদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছিল শিল্প-সাহিত্যের দেশটি। দ্বিতীয়বারের মতো ইউরোপের এই দেশটিতে বসেছিল বিশ্বকাপের আসর। বিশ্বমঞ্চের ষোড়শ আসরটা চিরস্মরণীয় হয়ে আছে তারকাবহুল টুর্নামেন্টের কারণে। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স, ইতালি, ইংল্যান্ডের মতো প্রায়সব বড় দলের ইতিহাসের নায়করা ছিলেন ওই বিশ্বকাপে। যা ফুটবল মহাযজ্ঞকে করে তুলেছিল অনন্য।

আসরটা স্বপ্নপূরণের উপলক্ষ হয়ে থাকল স্বাগতিক ফ্রান্সের জন্য। যে লালিত স্বপ্নে ১৯৩৮ সালে তৃতীয় বিশ্বকাপের আয়োজক হয়েছিল ফরাসিরা সেটা পূরণ হলো দীর্ঘ ছয় দশক পর। জিনেদিন জিদানের অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্সে প্রথমবার বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফি ঘরে তুলল ফ্রান্স।

রবার্তো কার্লোস, দুঙ্গা, কাফু, রোনালদো, রিভালদো, বেবেতোর মতো কিংবদন্তিরা হেরে গেলেন একজনের কাছেই। তিনি জিদান; ফ্রান্সের রূপকথার নায়ক। গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা, ডেভিড বেকহ্যামদের মতো তারকাদের ম্লান করে নিজেদের উঠোনে আয়োজিত আসরটাকে একান্তই নিজের করে নেন ফ্রেঞ্চ কিংবদন্তি।

যদিও ওই আসরে সেরা ফুটবলারের স্বীকৃতিটা পেয়েছিলেন রোনালদো। যা ব্রাজিলিয়ানদের জন্য দুঃস্মৃতির ক্ষতে শান্ত্বনার প্রলেপ হয়ে এসেছিল। ফাইনালে হেরে রানার্সআপ হলো সেলেকাওরা। পুরো আসরে দুর্দান্ত খেলা ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল ফ্রান্সের কাছে শেষ অবধি বিধ্বস্ত হলো ৩-০ গোলে!

৬০ বছর পর বিশ্বকাপ ফিরেছে ফ্রান্সে। ভোটাভুটিতে মরক্কোকে হারিয়ে দ্বিতীয়বার ফুটবলযুদ্ধ আয়োজনের সুযোগ পায় ফ্রান্স। তৃতীয় দেশ হিসেবে দুটি বিশ্বকাপের স্বাগতিক হওয়ার সুবর্ণ সুযোগটা কাজে লাগায় ফরাসিরা। শুধু মাঠের পারফরম্যান্সেই নয়, অতিথি আপ্যায়নেও ফ্রান্স মুগ্ধ করেছিল গোটা বিশ্বকে।

জুরিখের ভোটাভুটিতে ১৯ ভোটের লড়াইয়ে ৫ ভোটের ব্যবধানে বিশ্বকাপ আয়োজনের স্বত্ব পায় ফ্রান্স। কিন্তু স্বাগতিক দেশ নির্বাচনে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছিল ফিফা। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই এমনই বিস্ফোরক তথ্যটা ফাঁস করে দেয় ২০১৫ সালে। ১৭ বছর পর কলঙ্কের কালিমা লেগে যায় ফিফা ও ফ্রান্সের ললাটে। মার্কিন সংস্থাটি প্রমাণ করে দেয় ফ্রান্সের কাছ থেকে ফিফার ঘুষ নেওয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্যটা।

তবে এই দুর্নীতির কারণে নয়, ফ্রান্স বিশ্বকাপ স্মৃতির ক্যানভাসে জায়গা করে নিয়েছে অন্য কারণে। সেবারই প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় ৩২ দলের বিশ্বকাপ। ২৪ দলের আয়োজনটা তৃতীয়বার আর করা হয়নি ফিফার। তবে দল বাড়ানোর ফিফার এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছিল সবাই।

ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ও স্বাগতিক বাদে মূলপর্বের বাকি ত্রিশটি টিকিটের জন্য বাছাইপর্বে অংশ নেয় ১৭৪টি দল। চূড়ান্তপর্ব নিশ্চিত হওয়া দলগুলো হচ্ছে- ফ্রান্স (স্বাগতিক), ব্রাজিল (চ্যাম্পিয়ন), নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন, অস্ট্রিয়া, মরক্কো, দক্ষিণ আফ্রিকা, তিউনিশিয়া, ডেনমার্ক, বেলজিয়াম, স্পেন, বুলগেরিয়া, ক্রোয়েশিয়া, ইরান, ইংল্যান্ড, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, রোমানিয়া, স্কটল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, প্যারাগুয়ে, যুগোস্লাভিয়া, মেক্সিকো, জাপান, আর্জেন্টিনা, চিলি, জ্যামাইকা, কলম্বিয়া, চিলি, সৌদি আরব ও দক্ষিণ কোরিয়া।

আট দল বেড়ে যাওয়ায় অবধারিতভাবেই নতুন একটা ফরমেটের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় ফিফা। গ্রুপপর্বে বত্রিশ দলকে আট ভাগ করার পদ্ধতিটার প্রচলন এখনো চলছে বিশ্বকাপে। প্রত্যেক গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ দল উঠে যায় নক আউটপর্বে। ৬৪ ম্যাচের বিশ্বকাপটা ফ্রান্সের বিভিন্ন শহরের মোট ১০টি ভেন্যুতে আয়োজন করা হয়।

বাতিস্তুতার হ্যাটট্রিকে জ্যামাইকে ৫-০ গোলে উড়িয়ে আসরের দুর্দান্ত সূচনা করে আর্জেন্টিনা। কিন্তু বাতিস্তুতা অ্যান্ড কোংকে কঠিন পরীক্ষা দিতে হলো নক আউটপর্বের শুরুতেই। নির্ধারিত সময়ে ইংল্যান্ডের সঙ্গে ২-২ গোলের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর টাইব্রেকারে বাজিমাত করে আর্জেন্টাইনরা। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে ঠিক এই জায়গায় দাঁড়িয়েই নেদারল্যান্ডসের কাছে স্বপ্নভঙ্গ হয় বাতিস্তুতাদের।

তবে গ্রুপপর্বে নরওয়ের কাছে হোঁচট খেলেও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল আর্জেন্টিনার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিবেশী দল ব্রাজিল। নেদারল্যান্ডস আর্জেন্টাইনদের যে পরিণতি দিয়েছিল, সেই একই পরিণতি ডাচদের উপহার দেয় ব্রাজিলিয়ানরা। টাইব্রেকারে নেদারল্যান্ডসকে ৪-২ গোলে উড়িয়ে ফাইনালে উঠে যায় সাম্বার দেশটি।

ফাইনালে অনভিজ্ঞ ফ্রান্সের বিপক্ষে ফেভারিট ছিল ব্রাজিলই। কিন্তু গোটা ফুটবল দুনিয়াকে চমকে দিলেন জিদান। প্রথমার্ধেই ব্রাজিলের জালে দুবার বল জড়িয়ে ফেলেন ফ্রেঞ্চ কিংবদন্তি। সেলেকাওদের পঞ্চম শিরোপাস্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে তাতেই। শেষ অবধি ফ্রান্সের কাছে ব্রাজিল নিঃশর্ত আত্মসমার্পণ করল। ফরাসিরা জিতে নেয় বহুল প্রতীক্ষিত সোনালি ট্রফিটা। বিশ্বকাপ উঠল নতুন রাজাদের হাতে।

ফ্রান্সের রূপকথার আসরে চমক দেখিয়েছিল আরো একটি দল। তাদের ইউরোপিয়ান প্রতিদ্বন্দ্বী ক্রোয়েশিয়া। এই দলটার কাছেই সেমিফাইনালে কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছিল ফরাসিদের। জিজু জাদুতে শেষ অবধি ২-১ গোলে হেরে থমকে যায় ক্রোয়েশিয়ার স্বপ্নটা। ক্রোটদের এত দূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন ডেভর শুকের। আসরে সর্বোচ্চ ছয় গোল করে এই ক্রোট কিংবদন্তি জিতে নেন গোল্ডেন বুট।