দল পর্যালোচনা: পর্তুগালের স্বপ্ন রোনালদোকে ঘিরেই

বিশ্বকাপের অভিষেক আসরেই গোটা ফুটবল দুনিয়াকে বিস্ময় উপহার দিয়েছিলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। আগুনঝরা পারফরম্যান্সে পর্তুগালকে তুলেছিলেন জার্মানি বিশ্বকাপের ফাইনালে। ‘সিআর সেভেন’ ওই আসরের উদীয়মান সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতিও পেয়েছিলেন। কিংবদন্তি অধিনায়ক লুইস ফিগোকে ছাপিয়ে রোনালাদো-ই হয়ে উঠেছিলেন পর্তুগিজদের নায়ক।

২০০৬ বিশ্বকাপের আগে পর্তুগালের ইতিহাসের সেরা দুই ফুটবলার ছিলেন ‘কালো চিতা’ খ্যাত ইউসেবিও এবং ফিগো। কিন্তু দুজনের একজনও পর্তুগিজদের স্বপ্নপূরণ করতে পারেননি। দেশের মানুষের আশাটা পূরণ করেন রোনালদো। পর্তুগালকে এনে দেন ইউরোর শিরোপা। দুই বছর আগের সেই স্মৃতিটা এখনো ভাসছে পর্তুগিজদের চোখে।

এবার বিশ্বকাপেও রোনালদোকে ঘিরে স্বপ্ন দেখছেন দেশের মানুষ। পর্তুগিজদের স্বপ্নটা একেবারেই অমূলক নয়। দেশ ছাড়ার আগে গণমাধ্যমকে সেটাই বলে গেছেন রিয়াল মাদ্রিদ উইঙ্গার। বলেছেন, ‘কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। বিশ্বকাপে যে কোনো কিছুই ঘটতে পারে।’

সেই ‘কিছু’ একটা ঘটাতে মরিয়া হয়েই রাশিয়ার মঞ্চে নামবে পর্তুগাল। রোনালদোর জন্য এটা চতুর্থ বিশ্বকাপ। তার নেতৃত্বেই সপ্তমবারের মতো ফুটবল মহাযজ্ঞে অংশ নিচ্ছে পর্তুগিজরা। আসরটা একান্তই নিজের করে নেওয়ার স্বপ্ন দেখছেন বর্ষসেরা ফুটবলার। কারণ পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ারে সম্ভাব্য সবকিছুই জিতেছেন তিনি, তার অপূর্ণতা শুধু বিশ্বকাপ ট্রফি।

১৯৩০ সালে প্রথম বিশ্বকাপেই অংশ নেওয়ার সুযোগ ছিল পর্তুগালের। কিন্তু ইউরোপিয়ানদের বিশ্বকাপ বর্জনের মিছিলে যোগ দিয়েছিল তারা। পর্তুগিজদের প্রথম বিশ্বকাপ খেলার জন্য অপেক্ষা করতে হয় ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত। ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম আসরেই চমক নিয়ে হাজির হয়েছিল দ্য নেভিগেটর্সরা।

হাঙ্গেরির বিপক্ষে দুঃস্বপ্নের হারে অভিষেক হলেও ইউসেবিও বাহিনী বিস্ময় উপহার দিতে শুরু করে এরপর থেকেই। ‘কালো চিতা’ খ্যাত এই কিংবদন্তির দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের সুবাদে সেমিফাইনালে উঠে যায় পর্তুগিজরা। বুলগেরিয়া ও আগের আসেরর চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের মতো দলকে বিদায় করে রূপকথার একটা আসর খেলেছিল তারা। কিন্তু স্বাগতিক ইংল্যান্ডের কাছে হেরে ছিটকে যায় পর্তুগাল।

অবশ্য রাজসিক আসরের পরই হারিয়ে যায় পর্তুগাল। চারটি বিশ্বকাপে বাছাইপর্বেই থমকে যায় তাদের মূলপর্বের আশাটা। ১৯৮৬ বিশ্বমঞ্চে ফিরলেও ফেরাটা স্মরণীয় করে রাখতে পারেনি পর্তুগিজরা। মেক্সিকোর মঞ্চ থেকে তারা বিদায় নেয় প্রথম রাউন্ডে। এরপর আবার সেই বাছাইপর্বের দেয়াল। টানা তিনবার দর্শক সারিতে জায়গা হয় তাদের।

২০০২ সালে বিশ্বমঞ্চে ফেরা পর্তুগাল এবারো বিদায় নেয় প্রথম রাউন্ডে। তবে পরেরবার জার্মানি বিশ্বকাপে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে তারা। রোনালদো-ফিগো ফিরিয়ে আনেন ইউসেবিওর সোনালি অতীত। কিন্তু এবারো ফাইনালের আগেই থেমে যায় তাদের মিশন। ফ্রান্সের কাছে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নটা জমা দিয়ে দেশে ফিরে আসে পর্তুগাল।

সেই হারের মধুর প্রতিশোধটা দুই বছর আগে ইউরোর ফাইনালে নিয়েছেন রোনালদো অ্যান্ড কোং। স্বাগতিক ফরাসিদের কাঁদিয়ে পর্তুগাল জিতে নেয় তাদের ইতিহাসের প্রথম কোনো বড় শিরোপা। রোনালদোরা যখন প্যারিসে উচ্ছ্বাসে মাতোয়ারা তখন ফ্রান্স যেন হয়ে উঠেছিল কোনো এক মৃত্যুপুরী। এ যেন নিজ গৃহে পরবাসী ফ্রান্স!

পর্তুগালের ইতিহাস সেরা সাফল্যের নেপথ্য নায়ক ফার্নান্দো সান্তোস। তার দারুণ রণকৌশলের ফসল হিসেবে স্বপ্নের ইউরো জেতে পর্তুগিজরা। গত বিশ্বকাপেও তার অধীনে খেলেছিল নেভিগেটর্সরা। তবে দল বিদায় নেয় গ্রুপপর্বেই। বিদায়ের সেই শোকটা শক্তিতে পরিণত করে ইউরোতে বাজিমাত করে সান্তোসের দল।

ইউরোর বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা এবারো স্বদেশি কোচের অধীনে রাশিয়ায় পৌঁছেছে। লক্ষ্য- রাশিয়া ও বিশ্বজয় করা। পর্তুগিজদের আশার পালে হাওয়া দিচ্ছে র‌্যাঙ্কিংয়ে চার নাম্বার পজিশনটা। গেল এপ্রিলে ইতিহাস সেরা র‌্যাঙ্কিং তিনেও তো উঠে এসেছিল ইউরো চ্যাম্পিয়নরা।

অবশ্য র‌্যাঙ্কিং তালিকাটা এবং রেটিং পয়েন্ট শুধুই কয়েকটা সংখ্যা। পর্তুগিজদের ভাবাচ্ছে সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স। গত মার্চে বিশ্বকাপের টিকিট না পাওয়া নেদারল্যান্ডসের কাছে বিধ্বস্ত হয়েছিল তারা ৩-০ গোলে। পরের দুই ম্যাচে তিউনিশিয়া ও বেলজিয়ামের সঙ্গে ড্র। অবশেষে শেষ প্রস্তুতি ম্যাচে দলে ফিরেছেন রোনালদো। তার উপস্থিততে উজ্জীবিত পর্তুগাল আলজেরিয়াকে বিধ্বস্ত করেছে ৩-০ গোলে।

স্বাভাবিকভাবেই এবারের বিশ্বকাপের সেরা তারকাদের মধ্যে অন্যতম রোনালদো। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে বিদায়ী মৌসুমটা আলো ছড়ানো এই উইঙ্গার ফর্মটা টেনে আনতে চাইছেন বিশ্বকাপেও। এই স্বপ্নযাত্রায় তিনি সবচেয়ে বড় সঙ্গটা পেতে পেরেন বার্নাডো সিলভার কাছ থেকে। রাশিয়া বিশ্বকাপের যেসব তরুণ নজর কাড়তে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে তাদের মধ্যে একজন সিলভা। এ ছাড়া পর্তুগাল দলে পেপে, ক্যারিশমা, ব্রুনো আলভেসের মতো অভিজ্ঞ ফুটবলাররা তো আছেনই।

আজ থেকে শুরু হচ্ছে বহুল প্রতীক্ষিত ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’। তবে পর্তুগালের বিশ্বকাপ শুরু হচ্ছে আগামীকাল থেকে। এদিন নিজেদের প্রথম ম্যাচে অগ্নিপরীক্ষা দেবেন রোনালদোর। শুরুতেই যে তাদের সামনে পড়েছে ফর্মের তুঙ্গে থাকা সাবেক চ্যাম্পিয়ন স্পেন! ‘বি’ গ্রুপের বাকি দুই ম্যাচে অবশ্য তুলনামূলক সহজ প্রতিপক্ষ পাচ্ছে পর্তুগাল। গ্রুপপর্বের অন্য ম্যাচ দুটোতে মরক্কো ও ইরানের মুখোমুখি হবে তারা।