ফিরে দেখা ২০১০ বিশ্বকাপ: এবার স্পেনের কাছে ডাচদের স্বপ্নভঙ্গ

‘ওয়াকা ওয়াকা’ গানের তালে নেচেছিলেন শাকিরা। কলম্বিয়ান পপ সম্রাজ্ঞী নাচিয়েছিলেন গোটা বিশ্বকেই। সেই গানটা এখনো বাজছে দুনিয়াজুড়ে। ‘ওয়াকা ওয়াকা’ শোনামাত্রই যে কোনো ফুটবলপ্রেমীদের চোখে সামনে ভেসে উঠবে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপ। ২০১০ সালে শুধু সুরে-সংগীতেই নয়, সফল আয়োজক হিসেবে ফুটবল বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছিলেন আফ্রিকানরা।

আগের ১৮টি বিশ্বকাপের মঞ্চ বসেছিল ইউরোপ, আমেরিকা এবং এশিয়ার মাটিতে। ১৯তম বিশ্বকাপটা তাই আফ্রিকা মহাদেশে করার পূর্ব পরিকল্পনাটা আগে থেকেই নিয়েছিল ফিফা। মিশর, মরক্কো ও দক্ষিণ আফ্রিকার চতুর্মুখি ভোটযুদ্ধে নির্ধারণ হয় আয়োজক দেশের নাম।

দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট তথা প্রয়াত বর্ণবাদ বিরোধী বিশ্বনেতা নেলসন ম্যান্ডেলার সম্মানার্থেই আয়োজক দেশ হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকাকে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দিয়েছিল ফিফা। সুযোগটা দারুণভাবেই লুফে নেয় আফ্রিকানরা। ভোটাভুটিতে তারা হারায় মহাদেশীয় চার প্রতিদ্বন্দ্বী মিশর, মরক্কো, লিবিয়া এবং তিউনিশিয়াকে।

কিন্তু সফল সেই বিশ্বকাপ আয়োজনের পাঁচ বছর পর বিস্ফোরক একটা তথ্য ফাঁস করে ফিফা দুর্নীতি দমন কমিশন। ২০১৫ সালে তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে আর্থিক কেলেঙ্কারির লোমহর্ষক ইস্যুটা। বিশ্বকাপ আয়োজনের স্বত্ব পেতে তৎকালীন ফিফা সহ-সভাপতি জ্যাক ওয়ার্নার এবং নির্বাহী কমিটির সদস্য চুক ব্ল্যাজারকে ঘুষ দিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।

ওই বিতর্কটা বাদ দিলে ইতিহাসের অন্যতম সফল একটা বিশ্বকাপই উপহার দিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। সুদৃশ্য ১০টি ভেন্যুতে টুর্নামেন্ট আয়োজন করে তারা। কিন্তু এই বিশ্বকাপের আগে নতুন নিয়ম চালু করে ফিফা। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের সরাসরি মূলপর্বে খেলার পদ্ধতিটা বাতিল করে বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা।

আর তাতেই ইতিহাসের প্রথম চ্যাম্পিয়ন দল হিসেবে বাছাইপর্ব খেলতে হয় ইতালিকে। শুধু আজ্জুরিরাই নয়, ৩১ টিকিটের বাছাইপর্বে অংশ নেয় আরো ২০৩টি দল। দুশোর বেশি দলের এই বাছাই প্রতিযোগিতায় সফল অভিযান শেষ করে স্লোভাকিয়া। চেকোস্লোভাকিয়া বিভাজনের পর নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বকাপে আত্মপ্রকাশ করে স্লোভাকিয়ানরা।

২০১০ বিশ্বমঞ্চে অংশ নেওয়া দলগুলো হচ্ছে- দক্ষিণ আফ্রিকা (স্বাগতিক), ইতালি, মেক্সিকো, জাপান, হন্ডুরাস, আস্ট্রেলিয়া, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, আলজেরিয়া, নাইজেরিয়া, ঘানা, ক্যামেরুন, আইভরি কোস্ট, ফ্রান্স, স্পেন, গ্রিস, ডেনমার্ক, ইংল্যান্ড, পর্তুগাল, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, স্লোভাকিয়া, স্লোভেনিয়া, সার্বিয়া, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, চিলি, উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র।

রোমাঞ্চকর ওই বিশ্বকাপের আগে থেকেই ফেভারিটের কাতারে ছিল ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। কিন্তু দারুণ শুরু করা ল্যাটিন আমেরিকার দল দুটোকে বিদায় নিতে হয় কোয়ার্টার ফাইনালে। ব্রাজিল নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে এবং আর্জেন্টিনা এবারো থেমেছে জার্মানির কাছে।

অথচ সুইজারল্যান্ডের কাছে হার দিয়ে শুরু করা সেই স্পেনই হয়ে যায় চ্যাম্পিয়ন। ১১৬ মিনিটে কার্লোস পুয়োলের করা ম্যাচের একমাত্র ও জয়সূচক গোলে স্বপ্নের শিরোপা জিতে নেয় স্প্যানিশরা। তাতে আরো একবার শিরোপা হাতছোঁয়া দূরত্বে রেখে আসতে হয় নেদারল্যান্ডসকে।

জোহানেসবার্গের স্নায়ুক্ষয়ী ম্যাচটা বিশ্বকাপে ডাচদের তৃতীয় ফাইনাল হার। এর আগে ১৯৭৪ সালে জার্মানির কাছে প্রথমবার শিরোপা লড়াইয়ে হেরেছিল টোটাল ফুটবলের জনকরা। ঠিক পরেরবার আর্জেন্টিনার কাছে হেরে রানার্সআপের তকমা নিয়ে দেশে ফিরতে হয় কমলা শিবিরকে। সেই দুঃস্মৃতির ক্ষতে প্রলেপে দেওয়ার মোক্ষম সুযোগ পেয়েও শাপমোচন করতে পারেনি নেদারল্যান্ডস। তাই ফাইনালটা ডাচদের কাছে চিরকালীন একটা আক্ষেপের নাম হয়ে থাকল।

নেদারল্যান্ডসের দুঃস্বপ্ন এবং স্পেনের স্বপ্নের আসরে সুদিন ফিরিয়ে এনেছিল উরুগুয়ে। ডিয়েগো ফোরলানের প্রায় একক প্রচেষ্টায় চার দশক পর সেমিফাইনালে উঠেছিল দুইবারের বিশ্বসেরা দলটি। টুর্নামেন্টজুড়ে দ্যুতি ছড়ানোর পুরস্কার হিসেবে ফোরলান জিতে নেন সেরা খেলোয়াড়ের মুকুট তথা গোল্ডেন বল।

গোল্ডেন বুট পান টুর্নামেন্টের তৃতীয় সেরা দল জার্মানির কাণ্ডারি থমাস মুলার। অবাক করার বিষয় হচ্ছে তার সমান সর্বোচ্চ ৫ গোল করেছিলেন আরো তিনজন- ফোরলান, ডেভিড ভিয়া এবং ওয়েসলি স্নেইডার। কিন্তু এক ম্যাচ কম খেলায় বাজিমাত করেন মুলার (৬)।