আপনি পড়ছেন

যে মারে সে ভুলে যায়, কিন্তু যে মার খায়, সে কি কখনো ভুলতে পারে? গত তিন-চার দিন ধরে সহপাঠীর মৃত্যুর ঘটনায় রাজধানীজুড়ে স্কুল-কলেজের শিশু-কিশোরদের যে ক্ষোভের প্রকাশ দেখা যাচ্ছে, ওই প্রশ্নটাই কি তার মূল অনুপ্রেরণা নয়?

students protesters in dhaka

একবার ভেবে দেখুন, এ ধরনের সংবাদ শিরোনাম কতোবার দেখেছেন- অমুক জায়গায় সড়ক দুর্ঘটনায় স্কুল শিক্ষার্থীর মৃত্যু কিংবা সড়ক দুর্ঘটনায় আহত অমুক আর বেঁচে নেই?

এটা ঠিক যে, একটা নতুন ঘটনা যখন বাজারে ছড়িয়ে পড়ে, আমরা তখন পুরোনো ঘটনা ভুলে যাই। একটা নতুন কান্নায় যখন আকাশ ভারী হয়ে উঠে, আমরা তখন পুরোনো কান্নার কথা বেমালুম ভুলে যাই। তারপরও আমাদের একথা ভোলার কথা নয় যে, সত্যিই আমরা প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংবাদ শুনি, টিভিতে দেখি বা কাগজে-অনলাইনে পড়ি।

এই শিক্ষার্থীরা তো বটেই, রাজধানীবাসী এবং পুরো দেশের লাখো মানুষ প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। কেউ একা মরে যাচ্ছেন রাস্তায়, আবার কেউ মরছেন পরিবার নিয়ে। কেউ কেউ আবার না মরে পড়ছেন বিপদে- বছরের পর বছর তাদের জীবন কাটছে হুইলচেয়ারে বা বিছানার অসহ্য মুহূর্তে।

সড়কের এই নৈরাজ্যের জন্য শুধু ভাগ্যকে দোষ দিয়ে আসছি আমরা। ঘুমন্ত চালক রাস্তায় বাসের জন্য অপেক্ষায় থাকা যাত্রী সাধারণের উপর বাস তুলে পিষে দিয়ে যাচ্ছে। আর আমরা ভাগ্যকে দোষ দিয়ে বিলাপ করে যাচ্ছি। যেনো আমাদের ভাগ্যটাই বাস হয়ে চাপা দিচ্ছে আমাদের!

কিন্তু আর কতো? প্রাপ্তবয়স্করা নানা ভয়ে চুপ করে থাকছি। হয়তো আমাদের একটা ন্যয়সঙ্গত প্রতিবাদের কারণে ঝড় আসবে পরিবারে। ছোট ভাইটা স্কুলে যায়, ছোট বোনটা কলেজে যায়, আমার প্রতিবাদের কারণে যদি তার উপর কোনো বিপদ নামে?

এ রকম হাজারটা ভয়ে আমরা চুপ করে থাকি বা থেকেছি। কিন্তু আমাদের ছোট ভাইটার সে ভয় নেই। ছোট বোনটা অতো ভীতু নয়। কারণ ওদের কাছে পুলিশ মানে এখনো হয়তো নিরাপত্তার প্রতিশব্দ। ওদের কাছে এখনো রাষ্ট্র মানে নিজের মা। ওরা তাই প্রতিবাদ করতে পারে।

ওদের পবিত্র মন আছে বলেই ওরা মনে করে বিচার চাইলে বিচার পাবো। ওদের এই বিশুদ্ধ চিন্তার পক্ষে যারা নেই, ওরা তাদের কথা শোনে না। সুতরাং রাষ্ট্রের উচিত ওদের কথা শোনা। কারণ ওরা রাষ্ট্রের ক্ষমতা চায় না। ওরা চায় নিরাপদ সড়ক।

ওরা কারো কথা শোনে না

বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা। মিরপুর ১০ নম্বরে বিচার চেয়ে আন্দোলনরত শিশু-কিশোরদের ভিড়। বেশির ভাগের পরনেই স্কুলড্রেস। যদিও একদিন আগে শিক্ষামন্ত্রী সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। বাচ্চারা কি এতেই বেশি করে আন্দোলনে নামার সুযোগ পেলো? সম্ভবত- হ্যাঁ।

মিরপুর ১০ নম্বরে বেলা ১১টা থেকেই বাড়তে থাকে আন্দোলনকারী কিশোরদের ভিড়। বিভিন্ন স্কুল থেকে ছোট ছোট মিছিলে ১০ নম্বর ঘিরে ফেলে তারা। কিন্তু স্বচক্ষে দেখেছি, ওরা কোনো বাস ভাঙেনি, কোনো গাড়িকে আক্রমণ করেনি।

এর মধ্যেই একটা র‍্যাব ও আর্মির গাড়ি যাচ্ছিলো সেখান দিয়ে। দৌড়ে গেলো কয়েকজন ছেলে। কোনো ভয় নেই ওদের চোখে। সোজা কথায় বলতে শুনলাম- স্যার, লাইসেন্স দেখান। র‍্যাবকে একটুও রাগ করতে দেখলাম না। গাড়িচালক তার লাইসেন্স দেখালেন। কিন্তু ওরা নাছোড়বান্দা। গাড়ির লাইসেন্স দেখাতে হবে। র‍্যাব তাও দেখালো এবং কিছুক্ষণ পর ধীরে চলে গেলো।

একই ঘটনা ঘটলো একটি আর্মির গাড়ির সাথে। পাশেই যেহেতু ক্যান্টনমেন্ট, সেহেতু আর্মির গাড়ির এ রকম চলাচাল স্বাভাবিক। বাচ্চারা সেই গাড়িটাও থামালো। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে কিছুটা আতঙ্কে ছিলাম। কিন্তু আর্মিও র‍্যাবের মতো আন্দোলনকারীদের সাথে অত্যন্ত খোশমেজাজে চলে গেলো। এসময় আমি আর্মির গাড়ির চালকের মুখে হাসিও দেখেছি।

একদিন আগে এই বাচ্চারাই বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের উল্টো পথে আসা গাড়িকে সোজা পথে ঘুরিয়ে দিয়েছে। এসময় তাদের সম্বোধনের ভাষা ছিলো- ‘স্যার’। গর্বের ব্যাপার হলো, এই বাচ্চারা ইতিহাস সচেতন। তোফায়েলের গাড়ি সোজা পথে ঘুরিয়ে দেয়ার সময় স্কুলছাত্ররা তাকে শুনিয়ে দিয়েছে যে, তিনিও এক সময় ছাত্রনেতা ছিলেন। তাকে তাই নিয়ম ভাঙা মানায় না!

ওদের কথা শুনুন

স্কুল-কলেজের এই বাচ্চাদের কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ নেই। এ দেশের রাজনীতিবিদরা এখনো রাজনীতিকে ভালোবাসার মতো কিছু করে দেখাতে পারেননি। ফলে রাজনীতিতে এখনো ওদের তীব্র ঘৃণা। ওদের রাজনৈতিক অভিলাষ নেই এ কারণেই। ওদের কথা শোনা তাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

ওদের মূল দাবি, ওদের সহপাঠীর মৃত্যুর বিচার। রাষ্ট্র কেনো সেই বিচার করতে গড়িমসি করবে? তবে কি রাষ্ট্র এই মৃত্যুর পক্ষে? অত্যন্ত যৌক্তিক এই প্রশ্ন যদি ওরা তোলে, রাষ্ট্রের উত্তর কী?

রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের কাছে আমার আরজ, বাচ্চাদের বিচারের দাবি মেনে নিন এবং যেসব ব্যক্তির দেয়া সাহসে সড়কের নৈরাজ্য দিনে দিনে বেড়ে চলছে, তাদের চিহ্নিত করে বিদায় করুন। না হলে শিশু-কিশোরদের পবিত্র মনের কাছে রাষ্ট্রের যে অপরাধী ও অত্যাচারী রূপ গেঁথে যাবে এবং তা থেকে যে ক্ষোভের জন্ম হবে, সেই ক্ষোভ সামলানোর শক্তি কিন্তু পাবেন না।

হে রাষ্ট্র, প্রতিদিন সড়কে অসংখ্য মানুষের প্রাণ নিয়ে আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন, কিন্তু যারা এই পরিণতির শিকার হচ্ছে তারা ভুলছে না। এই কথাটা অন্তত মনে রাখুন।

লেখক: সাইফ হাসনাত, সাংবাদিক

প্রিয় পাঠক, ভিন্নমতে প্রকাশিত লেখার বিষয়বস্তু, রচনারীতি ও ভাবনার দায় একান্ত লেখকের। এ বিষয়ে টোয়েন্টিফোর লাইভ নিউজপেপার কোনোভাবে দায়বদ্ধ নয়। ধন্যবাদ।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর