আপনি পড়ছেন

বিগত কয়েকদিন ধরে ফেসবুকে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। তথাকথিত সুন্দরী প্রতিযোগিতার ওই ভিডিওটিতে একজন প্রতিযোগিকে জিজ্ঞেস করা হয় বাংলাদেশ নিয়ে তোমার উইশ কী? অন্য আরেক প্রতিযোগিকে জিজ্ঞেস করা হয় H2O মানে কি? এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে প্রতিযোগিরা ঘাবড়ে গিয়ে অন্যরকম উত্তর দিয়েছেন। তাদের দেয়া সেই উত্তর নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে নানা ধরনের সমালোচনা আর ট্রল।

beautiful competition and the dilemma of our question answer

লেখার শুরুতেই মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতার শুরুর দিককার ঘটনাবলীর দিকে আলোকপাত করা যাক। বিশ্বের অন্যতম সুন্দরী প্রতিযোগিতা মিস ওয়ার্ল্ডের যাত্রা শুরু হয় সেই ১৯৫১ সালে। শুরুর দিকে এটির প্রচলন ছিল বিকিনি প্রতিযোগিতা হিসেবে। পরে কালের বিবর্তনে এটি মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতায় রূপ নেয়। অনেক সমালোচনার কারণে ১৯৫২ সালে সুন্দরী প্রতিযোগিতা শুরুর সময়েই বিকিনি নিষিদ্ধি করা হয়।

পরে এটি ১৯৯৭ সালে ফের চালু হয়। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ১৯৯৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২১ বছর এই প্রতিযোগিতা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিলেন। যে কারণেই কি না বিভিন্ন সময়ে ট্রাম্পের সঙ্গে সুন্দরীদের নানা ধরনের মেলামেশার খবর গণমাধ্যমে আসে। অর্থাৎ প্রতিযোগিতার বাইরেও এখানে অন্য কোন বিষয় থাকলেও থাকতে পারে। 

বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতার পক্ষে-বিপক্ষে নানামত রয়েছে। একদল মনে করেন, প্রতিযোগিতার নামে নারীদের বিকিনি পরিয়ে মেধার মূল্যায়ন না করে শারীরিক গঠনের দিকটির বিচার করা হয়। যা নারীকে পণ্য হিসেবেই তুলে ধরার নামান্তর। আর সেরা সুন্দরী সিলেক্ট করতে গিয়ে এসব প্রতিযোগিতা নারীর উচ্চতা, শারীরিক গঠন, এমনকি নারীর গায়ের রঙের একটা মাপ নির্ধারণ করে দেয়। ফলে যেসব নারী সৌন্দর্যের এসব মাপকাঠি অর্জন করতে পারেন না, তারা হীনমন্যতায় ভোগেন।

আবার অনেকে সৌন্দর্যের এসব মাপকাঠি অর্জন করতে গিয়ে নানারকম পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যান। অথচ কবি-সাহিত্যিকরা যুগে যুগে বিভিন্নরকম নারীর প্রেমে পড়েছেন। যাদের কাছে তাদের প্রিয়ার সৌন্দর্যের কোন মাপকাঠি নেই। আবার প্রত্যেক সত্যিকারের প্রেমিকের চোখে তার প্রেমিকাই সবচেয়ে বেশি সুন্দর। প্রত্যেক কন্যাই তার বাবার কাছে রাজকন্যা। কাজেই প্রত্যেক নারীই তার বিশেষ মানুষটির কাছে সবচেয়ে বেশি সুন্দর।

সুন্দরী প্রতিযোগিতাকে অনেকে আবার ইতিবাচক হিসেবে দেখেন। অনেকে ভাবেন, সুন্দরী প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন হয়। পাশাপাশি নারীদের মেধা, নেতৃত্বদানের ক্ষমতা, শিক্ষাগত যোগ্যতাকে বিবেচনায় আনা হয়। অনেকে আবার বলছেন, এসব প্রতিযোগিতা নারীকে ঘরের বাইরে নিয়ে আসছে। নারীর কাজের ক্ষেত্র তৈরি সহজ হচ্ছে এবং স্টেজে পারফর্ম করার কারণে নারীর আত্মবিশ্বাস বাড়ছে।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এসব সুন্দরী প্রতিযোগিতায় কী হয়? প্রথমে সৌন্দর্যের মাপকাঠি নির্ধারণ করে তথাকথিত নারীদের সৌন্দর্যের খোঁজ করা হয়। এরপর তথাকথিত সেই সুন্দরীদের মধ্যে মেধার খোঁজা করা হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই মেধা এবং সৌন্দর্যের সমন্বয় হওয়ার সুযোগ অনেক কম।

গত দুই বছর ধরে অন্তর শোবিজ এ দেশে 'মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ' অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। গত বছর বিজয়ীকে নিয়ে নানা ধরনের ঘটনা ঘটে যায়। অভিযোগ ওঠে স্বেচ্ছাচারিতা আর পক্ষপাতের। সেবার প্রথমে বিজয়ী ঘোষণা করা হয় জান্নাতুল নাঈম এভ্রিলকে। পরে বিবাহের তথ্য গোপন করার অভিযোগে এভ্রিলকে বাদ দিয়ে জেসিয়া ইসলামকে বিজয়ী ঘোষণা করে চীনে পাঠানো হয়। এবারের আসরেও আগেভাগে বিজয়ীর নাম ফাঁস হয় এবং শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হন জান্নাতুল ফেরদেৌস ঐশী। ফলে বিভিন্ন মহলে আয়োজকদের আয়োজন, বাছাই প্রক্রিয়াসহ পুরো সিস্টেমটাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।

যে বিষয়টিকে ঘিরে এই লেখার অবতারণা এবার সেই মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ প্রতিযোগিতার বিচারকদের প্রশ্ন ও প্রতিযোগীদের উত্তরের বিষয়ে আলোকপাত করা যাক। এবারের প্রতিযোগিতার মূল আসরে বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছেন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী শুভ্রদেব, মডেল ও অভিনেতা খালেদ সুজন, মডেল ইমি এবং ব্যারিস্টার ফারাবী। অন্যদিকে ফাইনালের আইকন বিচারক হিসেবে ছিলেন মাইলস ব্যান্ডের শাফিন আহমেদ, হামিন আহমেদ এবং নৃত্যশিল্পী আনিসুল ইসলাম হিরু। তবে বিচারকদের মধ্যে ইমি এবং খালেদ সুজনের প্রশ্নের ধরণ এবং 'সুন্দরী প্রতিযোগীদের' উত্তরে উত্তাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। 

বেশিরভাগ নেটিজেন চূড়ান্ত পর্বে আসা এসব প্রতিযোগীদের নির্বুদ্ধিতা, অঙ্গভঙ্গি এবং বিচারকদের প্রশ্নের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। একটা বিষয় জানিয়ে রাখা ভালো যে, আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, সারা দেশের প্রায় ত্রিশ হাজার প্রতিযোগী এই লড়াইয়ে নামার জন্য রেজিস্ট্রেশন করেছিলেন। এর মধ্য থেকে চূড়ান্ত লড়াইয়ে আনা হয়েছে দশজনকে। অর্থাৎ নানা ধাপ পার হয়েই এই প্রতিযোগীরা সেরা দশে এসেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, যারা এতোটা পথ পেরিয়ে এই অবস্থানে এসেছেন, তারা কেন এমন সহজ প্রশ্নের উত্তর দিতে হিমশিম খাবে! এখানে বিচারকদের বাছাই করার দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা খুবই স্বাভাবিক। এদিকে আয়োজকরা এসব প্রতিযোগীকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছেন, ব্যক্তিত্ব গঠনের জন্য গ্রুমিং করেছেন। তারপরও প্রতিযোগীদের এই অবস্থা! তাহলে কাদের নিয়ে হাসাহাসি করার কথা আর আমরা কী করছি?

এবার আলোচনা করা যাক, হাসাহাসি করা সেইসব প্রশ্ন আর উত্তরের বিষয়ে। 'মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ-২০১৮' প্রতিযোগিতায় প্রশ্নোত্তর পর্বের একটা অংশে একজন প্রতিযোগীর উদ্দেশে মডেল ও অভিনেতা খালেদ সুজনের করা প্রশ্ন ছিল, 'আমাকে একটু বলবা, এইচটুও (H2O) মানে কি? এইচটুও মানে কি? এ সময় উত্তর দিতে না পেরে প্রতিযোগী হাসেন। এসময় বিচারক আবার বলেন, এইচটুও মানে হচ্ছে পানি। ঠিক এ সময় প্রতিযোগী বলে ওঠেন, 'এইচটুও নামে ধানমন্ডিতে একটা রেস্টুরেন্ট আছে।' আরেক প্রশ্নে সুজন বলেন, 'আমার প্রশ্ন হলো, পানি আমরা বিশুদ্ধ করি ফিল্টার করে। তোমাকে যদি বলি একটা মানুষকে বিশুদ্ধ করো। তাহলে তুমি তার মধ্যে কী কী ফিল্টার করবে।' এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি প্রতিযোগী।

আমার প্রশ্ন হচ্ছে, পূর্ব কোন ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ করে কাউকে যদি জিজ্ঞেস করি (NH3) এনএইচ থ্রি মানে কি? বিষয়টাতে অনেকেই ঘাবড়ে যাবেন। আর ফ্যাশন সচেতনরা হয়তো বলবেন, ক্রিকেটার নাসির হোসেনের ব্রান্ডের কোন নতুন পণ্য বা আউটলেট হয়তো এনএইচ থ্রি। আসলে এনএইচথ্রি হচ্ছে অ্যামোনিয়া গ্যাসের রাসায়নিক সংকেত। একই প্রশ্ন যদি এভাবে করি যে, এনএইচ থ্রি কিসের রাসায়নিক সংকেত তাহলে হয়তো অনেকের পক্ষে উত্তর দেয়া সহজ হবে। সুন্দরী প্রতিযোগিতায় প্রশ্নকর্তা যদি, এইচ টু ও কিসের রাসায়নিক সংকেত? এভাবে জিজ্ঞেস করতেন তাহলে হয়তো প্রতিযোগী হয়তো উত্তর দিতে পারতেন। আর উত্তর দিতে না পারলেও রেস্টুরেন্টের বিষয়টা ভুলেও মাথায় আনতেন না। আরেকটা প্রশ্নে বিচারক, মানুষকে ফিল্টার আর পানি ফিল্টারের বিষয়টা এক করে ফেলেছেন। এটা আবার কেমন প্রশ্ন! 

আরেক ক্ষেত্রে বিচারক ইমিকে প্রশ্ন করতে দেখা যায়। তিনি বলেন, 'গুড ইভিনিং না আসলে গুড নাইট। আমার কোয়েশ্চেনটা, আমি আসলে এতো বেশি ইনটেলেকচুয়াল প্রশ্ন করতে পারি না। আই ফিল আন কমফরটেবল। বিকজ আই থিং আমার চাইতে এখান সব গর্জিয়াস লেডিরা আছেন। এখানে ইনটেলেকচুয়াল প্রশ্ন করাটা ঠিক হবে না। একটা ইজি প্রশ্ন করবো। তোমাকে যদি তিনটা উইশ দেয়া হয়, লাইক নিজের জন্য একটা উইশ করতে পারবে অর ফ্যামিলির জন্য একটা উইশ করতে পারবে অর ফর ইওর কান্ট্রির জন্য একটা উইশ করতে পারবে। তাহলে কোন উইশটা তুমি পছন্দ করবে এবং সেটা কি?' জবাবে প্রতিযোগী বলেন, 'অ্যাট ফার্স্ট অবশ্যই আমার কান্ট্রির জন্য উইশ করব।' কিন্তু বিচারক শুনতে পান প্রতিযোগী ফ্যামিলির জন্য উইশ করবেন।

এরপর বিচারক ইমি বলেন, 'আচ্ছা তুমি ফ্যামিলির জন্য উইশ করবে। সেটা কী?' প্রতিযোগী বলেন, 'বাংলাদেশকে নিয়ে আমি যেটা উইশ করতে চাই সেটা হচ্ছে, বাংলাদেশে একটা লংগেস্ট সি বিচ আছে। সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। দ্যান বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সুন্দরবন। অনেক বিউটিফুল। নেক্সট আমাদের দেশে অনেক সুন্দর সুন্দর পাহাড় পর্বত রয়েছে। আমি এগুলোকেই উইশ করব।' এ সময় ইমি বাংলা আর ইংরেজি মিশিয়ে প্রতিযোগিকে নানাভাবে উইশ মানে বোঝানোর চেষ্টা করেন। কোনো একজন বিচারকের নিজের উচ্চারণ ভঙ্গি এতো বাজে যে না শুনলে বিশ্বাস করা কঠিন। আর বিচারক উইশ শব্দটির মানে বোঝাতে একবারও ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা বা এসবের কোন প্রতিশব্দ ব্যবহার করেননি। তার প্রতিটা বাক্য ছিল ইংরেজি এবং বাংলার সংমিশ্রণে তৈরি।

কাজেই শুধু শুধু প্রতিযোগী মেয়েগুলিকে নিয়ে হাসাহাসি করবেন না। তাদেরকে যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাছাই করা হয়েছে, যারা গ্রুমিং করিয়েছেন এমনকি যারা এমন উদ্ভট প্রশ্ন করেছেন এই লজ্জাটা প্রকৃতপক্ষে তাদের পাওনা। তবে আলোচনার শেষে একটি কথা বলতেই হয়, আয়োজক এই প্রতিযোগিতাকে সব জায়গায় ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন, হোক না সেটা নেতিবাচক প্রচারণা। এখানেই মূলত তাদের বাণিজ্যিক লাভ।

যাকারিয়া ইবনে ইউসুফ
সাংবাদিক
ইমেইল : This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.

প্রিয় পাঠক, ভিন্নমতে প্রকাশিত লেখার বিষয়বস্তু, রচনারীতি ও ভাবনার দায় একান্ত লেখকের। এ বিষয়ে টোয়েন্টিফোর লাইভ নিউজপেপার কোনোভাবে দায়বদ্ধ নয়। ধন্যবাদ।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর