আপনি পড়ছেন

মাহে রমজানের অন্যতম আকর্ষণ তারাবির নামাজ। সুমধুর তেলাওয়াত তারাবিকে আরো প্রাণবন্ত করে তোলে। কিন্তু তারাবির নায়ক হাফেজদের সুখ-দুঃখ কতটুকুই আমরা জানি। কখনো কি ভেবেছি- তারাবির নামাজ পড়ানো হাফেজদেরও কিছু কষ্ট আছে। আছে বুক ভাঙ্গা কান্না। অবাক হলেও সত্য! পুরো রমজানে যিনি সবচেয়ে বেশি রাকাত নামাজ আমাদের পড়ান, সে হাফেজ মসজিদ কমিটি থেকে শুরু করে ইমাম-মুয়াজ্জিন এমনকি খতিবের মাধ্যমেও নানা হয়রানির শিকার হন।

quran

দীর্ঘ ২০ বছর তারাবি পড়ানোর অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে দেশ সেরা হাফেজ আল আমিন সরকার বলেন, মানুষের দোয়া আল্লাহয় দয়ায় রেডিও-টেলিভিশনে সেরা তেলাওয়াতকারী স্বীকৃতি পেয়েছি। ইউটিউবে আমার তেলাওয়াতের ভিউ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। অন্যান্য হাফেজরা আমাকে বলেন, ভাই, আপনার তেলাওয়াতের স্টাইল রপ্ত করে যেখানে ইন্টারভিউ দিচ্ছি সেখানেই এলাউ হচ্ছি। সেই আমিও এ বছর একটি মসজিদে ইন্টারভিউর নামে হয়রানির স্বীকার হয়েছি।

ওই হাফেজ আরো বলেন, স্বজনপ্রীতি এমনকি আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমেও হাফেজ নিয়োগের ঘটনা অনেক আগে থেকেই দেখে আসছি। সেক্ষেত্রে যারা ইন্টারভিউ নেয়, তারা বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করে অযোগ্য হাফেজদের সিলেক্ট করেন। অধিকাংশ ইন্টারভিউই লোক দেখানো। ‘ধর্মদালাল’দের নিপুণতায় (!) হাফেজ সিলেক্ট হয়ে যায় ইন্টারভিউর আগেই। হাফেজ নিয়োগে সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হলো, সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে পাস করার পরও বয়স কম কিংবা দাড়ি ওঠেনি এ অজুহাতে যোগ্য হাফেজকে বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্য হাফেজ নিয়োগ করা হয়। অথচ শরিয়তে বয়স কিংবা দাড়ি ওঠা তারাবির জন্য শর্ত নয়।

হাফেজ আল আমিন সরকার বলেন, 'হাফেজদের সঙ্গে সবচেয়ে ন্যক্কারজনক যে ঘটনাটি ঘটে তা হল, আমি কোনো মসজিদে ৮-১০ বছর ধরে তারাবি পড়াচ্ছি। এতদিনে কমিটি কিংবা খতিবের ছেলে, ভাতিজা, শ্যালক হাফেজ হয়ে বেরিয়েছে। এখন আমাকে বাদ দেয়ার জন্য উদ্ভট সব কারণ দেখানো হয়। কারওয়ান বাজারের একটি মসজিদে দীর্ঘ আট বছর তারাবি পড়ানোর পড় মসজিদের খতিবের নাতি হাফেজ হলে আমাকে ছাড়ানোর অজুহাত স্বরূপ বলা হয়, এই হাফেজের পেছনে নামাজ পড়া মাকরূহ; তিনি গানের সুরে কোরআন পড়েন! আট-দশ বছর তারাবি পড়ানোর পর নতুন করে কোথাও ইন্টারভিউ দেয়ার মানসিকতা খুব কম হাফেজেরই থাকে। তখন এক মহাসঙ্কটে পড়তে হয় কোরআনের 'অসহায়' পাখিদের।'

কুমিল্লার একটি মসজিদের খতিব এবং তারাবি ইমাম হাফেজ মাওলানা শরফুদ্দিন আল হুসাইনি বলেন, 'হাফেজদের সঙ্গে সবচেয়ে নির্লজ্জ খেলাটি খেলা হয় ‘হাফেজ সাহেবের’ হাদিয়া নিয়ে। টাকা ওঠানো হয় হাফেজের নামে। কিন্তু ওই টাকা ভাগ হওয়ার পর খুব সামান্য অংশই হাফেজদের পকেটে আসে। ইমাম-মুয়াজ্জি-খতিব-খাদেম, মসজিদের ঋণ, কারেন্ট বিল আরো কত খাতে যে হাফেজের টাকা ভাগ হয়- তা কেবল মসজিদ কমিটিই ভালো বলতে পারেন।'

দারিদ্রপ্রবণ বাংলাদেশে অনেক হাফেজ তারাবির হাদিয়ায় পুরো বছরের পড়াশোনা এবং সংসারের খরচ চালান। কেউ আবার তারাবির হাদিয়ায় ভর্তি হবে, নতুন জামাতের কিতাব কিনবে এরকম পরিকল্পনাও করে থাকেন। মানুষও খুশি হয়ে হাফেজের জন্য সাধ্যমত হাদিয়ার ব্যবস্থা করেন। খুব কষ্টের সঙ্গে বলতে হয়, দশ ভাগের পর যে যৎসামান্য হাদিয়া হাফেজের ভাগ্যে জুটে, তার ওপরও একশ্রেণির আলেমনামধারী ধর্মব্যবসায়ী ফতোয়া জারি করেন বলেন, 'তারাবির নামাজ পড়িয়ে টাকা নেয়া হারাম।' এসব আলেমদের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়, আপনারা যে হাফেজের নামে তোলা টাকা নিজের পকেটে পুড়েন তা বুঝি খুব জায়েজ?

তারাবি পড়িয়ে হাদিয়া নেয়া জায়েজ-না জায়েজ এ বিষয়ে হাফেজ মাওলানা আল আমিন সরকার বলেন, 'দীর্ঘ বিশ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, যেসব মসজিদের খতিব হাফেজ, তারা তারাবির হাদিয়াকে জায়েজ বলেন। কারণ, মাস শেষে পুরো হাদিয়া তো তার পকেটেই আসবে। আর যে সব মসজিদের খতিব হাফেজ নন, তারা তারাবির হাদিয়াকে না জায়েজ না হারাম বলেন। এমনকি মসজিদে খতম তারাবি হোক এ বিষয়েও তাদের জোর আপত্তি থাকে। রোজার মাসে হাদিয়া-তোহফা যা আসে পুরোটাই যেনো তার পকেটে ঢুকে মূলত এজন্যই খতম তারাবি ও তারাবির হাদিয়ার ব্যাপারে হুজুরে (!) এমন বৈরি ফতোয়া।

পাঠক! রমজানজুড়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে তারাবি পড়ানো মানুষটি যে কত শত জুলুম-নির্যাতন, মানসিক নিপীড়ন, অমানবিক আচরণ সহ্য করে হাসি মুখে তারাবি পড়িয়ে যাচ্ছেন, এর পেছনে একটিই কারণ- আমরা মুসল্লিরা যেনো খতম তারাবির সওয়াব থেকে বঞ্চিত না হই। মুসল্লিদের জন্য যার মনে এত দরদ! এত ব্যথা! সে হাফেজের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমরা কি পারি না তার পাশে দাঁড়াতে! কোরআন সংরক্ষকের অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা মুসল্লিদেরই করা উচিত।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর