ভয়ংকর তামাাক: আসছে ২,৪০০ কোটি, যাচ্ছে পাঁচ হাজার কোটি টাকা

ধূমপান ও ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য সেবনের কারণে দিন দিন হৃদরোগ, ক্যান্সার, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, হাঁপানি, যক্ষাসহ বিভিন্ন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। একদিকে যেমন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে অন্যদিকে এসব রোগের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি ও অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় অর্থনৈতিকভাবেও নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন রোগী ও তার পরিবার।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, তামাকজাত দ্রব্যের কারণে হওয়া বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় প্রতি বছর ব্যক্তিগত ও সরকারিভাবে ব্যয় হচ্ছে পায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। অথচ এই তামাকখাত থেকে বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব আদায় হচ্ছে মাত্র ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ রাজস্ব থেকে যা আসছে রোগের পেছনে ব্যয় হচ্ছে তার চেয়েও দ্বিগুন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তামাকজাত দ্রব্য বাজারজাত করা কোম্পানিগুলো সবসময়ই সরকারকে অনেক বেশি রাজস্ব দেওয়ার কথা বলে থাকে। কিন্তু এসব তামাকদ্রব্য থেকে সৃষ্ট রোগ নিরাময় করতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়, তা সরকারের আদায়কৃত রাজস্বের তুলনায় অনেক অনেক বেশি।

এক সমীক্ষায় দেখা যায়, মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত ৯৫ শতাংশ রোগীরই ক্যান্সারের মূল কারণ পান, জর্দা ও গুল জাতীয় তামাকজাত দ্রব্য। যদিও ২০১৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান স্পিকার সামিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশকে ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে তুলবেন তিনি।

বাংলাদেশ ক্যান্সার ক্যানসার সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরাল অ্যান্ড মেক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মাহমুদা আক্তার বলেন, দেশে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এর মূল কারণ ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত পণ্য সেবন।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, তামাকজাত পণ্য সেবনের ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন রোগের স্বাস্থ্যসেবায় সরকার যে পরিমাণ ভর্তুকি দেয় এবং এ সংক্রান্ত বিষয়ে যে পরিমাণ বরাদ্দ থাকে তা আদায়কৃত রাজস্বের থেকে অনেক বেশি।

ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ২৭ বছর বয়সী মামুন। তার মা স্কুল শিক্ষিকা কবিতা খানম বলেন, 'তিন বছর আগে তারা স্বামী মারা যায়। এরপর এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে নিজের আয়েই চলছে তার সংসার। স্বপ্ন ছিল একসময় ছেলে পাশে দাঁড়াবে, সংসারের হাল ধরবে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ছেলের এমন অসুখে সবকিছু ছেড়ে তাকেই থাকতে হচ্ছে হাসপাতালে।

তিনি জানান, মামুন নিয়মিত ধূমপান করতো। তার এই অভ্যাসটা কিশোর বয়সেই তৈরি হয়েছিল। মামুনের বাবা ছেলেকে এই পথ থেকে ফেরানোর অনেক চেষ্টা করেও সফল হতে পারেননি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ওরাল অ্যান্ড মেক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছেন রাজিয়া বেগম। বেশ বড় একটি ঘা সৃষ্টি হয়েছে তার ডান পাশের গালে। গর্তের মতো হয়ে গিয়েছে সেখানে। এছাড়া ঠোঁটের পাশে জমা হয়েছে অতিরিক্ত কিছু মাংসপিণ্ড।

রাজিয়া বেগমের ছেলে শান্ত বলেন, পান খাওয়ার ফলে এক বছর আগে তার মায়ের মুখে ক্যান্সার ধরা পড়ে। প্রথমে নিজ জেলা চাঁদপুরে এবং গত একমাস আগে এখানে আনা হয় তাকে। চিকিৎসকরা ওষুধ দেওয়ার পাশাপাশি অস্ত্রোপচার করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

রাজিয়া বেগমের ছেলের বউ সালমা জানান, তার শ্বাশুড়ি সারাদিন শুধু ব্যথায় চিৎকার করেন। ঘুমানোর পর সবকিছু রক্তে ভেসে যায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় অনুযায়ী, বাংলাদেশে ধূমপান ও তামাকজাত পণ্য সেবনের ফলে প্রতিবছর আটটি মরণঘাতী অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয় প্রায় ১২ লাখ মানুষ। এদের মধ্যে অকাল পঙ্গুত্বের শিকার হয় প্রায় ৩ লাখ ৮২ হাজার মানুষ এবং সারাজীবন তামাকজনিত রোগে ভোগে প্রায় ১২ লাখ মানুষ।

এছাড়া ট্যোবাকো অ্যাটলাস শিরোনামের আন্তর্জাতিক এক প্রকাশনায় দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি বছর তামাকজনিত রোগে মারা যায় প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ। অসংক্রামক রোগের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে তামাক সেবনকে দায়ী করছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। তাদের মতে, দেশে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক ও হৃদরোগের মতো অসংক্রামক রোগের ঝুঁকিতে রয়েছে ৯৮ শতাংশ মানুষ।

ধূমপানবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এ বি এম জুবায়ের বলেন, দেশে অকালমৃত্যুর কারণগুলোর মধ্যে পঞ্চম স্থানে আছে তামাক। বর্তমানে বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তামাক মৃত্যু আর পঙ্গুত্বের বোঝা বাড়িয়ে সেই অগ্রযাত্রাকে স্তিমিত করছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টেকনিক্যাল অফিসার ড. মাহফুজুল হক বলেন, তামাক থেকে সরকার রাজস্ব পায়, কিন্তু তামাক ব্যবহারের কারণে অসুস্থ হওয়া রোগীর চিকিৎসায় ব্যক্তিগত ও সরকারের যে টাকা খরচ হয় সেটি রাজস্ব আদায়ের থেকে অনেক বেশি। তামাক সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিলে সরকার যে রাজস্ব হারাবে, তার থেকে বেশি গেইন করবে। কারণ তামাকের কারণে অর্থনীতিতে যে পরিমাণ লাভ হয়, তার থেকে বেশি ক্ষতি হয়।

অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, অনেকে মনে করেন ট্যোবাকো থেকে বেশি রাজস্ব আসে। কিন্তু অর্থনৈতিক ডাইমেনশনে দেখা যায়, এই সেক্টরে আয়কৃত রাজস্ব আর কর্মসংস্থানের চেয়ে এর প্রভাবে হওয়া অসুস্থতায় বেশি ব্যয় হচ্ছে । এছাড়াও একটি অসুস্থ জাতি নিয়ে গড়ে উঠছে বাংলাদেশ।