আপনি পড়ছেন

সৃষ্টির আদিকাল থেকেই সময়ে সময়ে বিভিন্ন রকমের দুর্যোগ বা মহামারি এসেছে। এর কোনোটা ছিল প্রাকৃতিক আবার কখনো কখনো মানবসৃষ্ট দুর্যোগেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ পৃথিবী।

corona remedy

প্রকৃতির পক্ষ থেকে অভিশাপ স্বরূপ দুর্যোগ হচ্ছে- ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস, সাইক্লোন, ঝড়-বৃষ্টি, বন্যা, খরা, সুনামি, দাবানল, টর্নেডো। আবার কখনো কখনো প্রকৃতির নানা অসঙ্গতির কারণে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি মানব সভ্যতাকে বিপদগ্রস্ত করেছে। প্রাণহানি হয়েছে লাখ লাখ। অর্থনীতিরও ছন্দপতন হয়েছে দেশে দেশে।

কৃত্রিম বা মানবসৃষ্ট দুর্যোগের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যুদ্ধ বিগ্রহ। পৃথিবীর ইতিহাসে মানবসভ্যতা বারবার কলঙ্কিত হয়েছে যুদ্ধ বিগ্রহের ভয়াবহতায়। ভূলুণ্ঠিত হয়েছে মানবিক মূল্যবোধ। পৃথিবী ইতোমধ্যে দুটি বিশ্বযুদ্ধের তাণ্ডবলীলা দেখেছে।

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধিতে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যার অধিকাংশই ভাইরাসজনিত। এসব ভাইরাস মানবসৃষ্ট নাকি প্রকৃতির তা সনাক্তকরণে রয়েছে ধোঁয়াশা। অনেক ক্ষেত্রে এসব ধোঁয়াশার অবসান হয়নি। বর্তমান সময়ে সারা পৃথিবীতে তাণ্ডবলীলা চালানো করোনা বা কোভিড-১৯ এরকম একটি ধোঁয়াশাময় ভাইরাসের নাম।

প্রতিটি মহামারির রেশ কাটাতে সমগ্র বিশ্বকে দীর্ঘ সময় সংগ্রাম করতে হয়েছে, হোক সেটা প্রাকৃতিক অথবা মানবসৃষ্ট। জনজীবন স্বাভাবিক করতে নিতে হয়েছে যুগান্তকারী সব উদ্যোগ।

প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ ছিল মানব সভ্যতার ওপর প্রথম অসভ্য আঘাত। পুরা পৃথিবী দেখেছে এর তান্ডবলীলা। পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও ছিল মানবতার বিরুদ্ধে আরো বড় চপেটাঘাত। অবশ্য উভয় বিশ্বযুদ্ধের পরও পৃথিবী সকল সংকট মোকাবেলা করে স্বাভাবিক গতিবেগে সামনের দিকে এগিয়েছে।

একটা সময় পৃথিবীর সমাজ ব্যবস্থা ছিল কৃষি নির্ভর। শস্য উৎপাদন, পশুপাখি পালন, শিকার এগুলোই ছিল মানুষের জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম। আল্লাহ পাক প্রত্যেক নবী রাসুলকে দিয়েই কৃষি কাজ করিয়েছেন। শেষ নবী হজরত মুহাম্মদও (সা.) মেষ চড়িয়েছেন। তিনি তার সাহাবীদেরকেও এ কাজের উৎসাহ উদ্দীপনা দিয়েছন।

মহামারি দেখা দিলে খাদ্য সংকট থেকে কিভাবে রক্ষা পাওয়া যায় মিশরের বাদশাহ হজরত ইউসুফ (আ.) এর জীবনী থেকে আমরা শিখতে পারি। টানা সাত বছর অনাবৃষ্টির কারনে ফসল উৎপাদন না হওয়ার পরও খাদ্য সংরক্ষণ করে কিভাবে তিনি দুর্যোগ মোকাবেলা করেছিলেন।

বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা কৃষি নির্ভর নয়। ধীরে ধীরে তা শিল্প নির্ভর হয়েছে। মানুষ আধুনিকতার দিকে অগ্রসর হয়েছে। কল কারখানা গড়ে তুলেছে। কৃষি থেকে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতি চালু হয়েছে। শিল্প কারখানা যত বৃদ্ধি হতে থাকলো পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর তত আঘাত আসতে লাগলো। কল কারখানার বর্জ্য, কালা ধোঁয়া, সীসা বাতাসকে দূষিত করতে লাগলো। তখন থেকেই পৃথিবীতে বায়ুবাহিত নানা রোগের জন্ম নিল।

মানুষ প্রকৃতিকে শাসন করতে লাগলো। প্রকৃতির উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ নিল। ফলে গ্রীণ হাউস ইফেক্টস সহ নানা সমস্যা তৈরি হল। পৃথিবীর নিম্নভূমি আরো নিমজ্জিত হচ্ছে। সমুদ্র পৃষ্টের গভীরতা কমছে। মানুষই আবার নানা উদ্যোগ নিল প্রকৃতিকে স্বাভাবিক করার। কিন্ত ততদিনে প্রকৃতির অভিমান অনেক গভীরতায় পৌঁছে গেছে। প্রকৃতি তার বিরূপ প্রভাব পৃথিবীতে দেখাচ্ছে। দাবানলের দাউদাউ করা আগুনে পুড়ে যাওয়া অস্ট্রেলিয়া, আমাজন, রাশিয়া সবই প্রকৃতির অভিমানের ফসল। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতি তার নিজস্বতা হারিয়েছে।

আমরা প্রকৃতিকে কতটা অত্যাচার করেছি প্রকৃতি একটু ফুরসত পেলেই বুঝিয়ে দেয়। আজ করোনার জন্য কল কারখানা বন্ধ। প্রকৃতিতে বিষাক্ত ধোঁয়া নেই। বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধির সুযোগ কম। তাই এই সুযোগে প্রকৃতি তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করছে। নিজের মত করে সাজিয়ে নিচ্ছে নিজেকে। আরেকটু সময় পেলে হয়তো আমরা প্রকৃতির কাছ থকে লজ্জা পাবো তার সৌন্দর্য দেখে। তবুও সে ফিরুক স্বমহিমায়।

এবার আসা যাক মূলকথায়। পৃথিবীতে যতবারই যত দূর্যোগ বা মহামারি এসেছে ততবারই কমবেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সব মহামারির এক একটা বৈশিষ্ট্য থাকে। মহামারি বা দূর্যোগ একটা অঞ্চল, একটা দেশ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এক মহাদেশ আক্রান্ত হলে অন্য মহাদেশ স্বাভাবিক ছিল। একটা দেশ এখন আক্রান্ত হলে অন্য দেশ আরেক সময় আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু বর্তমান সময়ের করোনা মহামারিতে সারা বিশ্ব একই সাথে একই সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

পৃথিবীতে মহামারি এসেছে আবার চলে গেছে একটা নিদিষ্ট সময় পরে। দূর্যোগ বা মহামারি পরবর্তী সময়ে নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে মানুষ। খাদ্য সংকট, অর্থনৈতিক সংকট সহ জীবন জীবিকা ব্যাহত হওয়ার মত সংকট তৈরি হয়েছে।

করোনা নামক মহামারি পূর্বেকার সকল মহামারির চেয়ে ব্যতিক্রম। সারা বিশ্বকে একই সময়ে একই সাথে আঘাত করেছে। তাই এর মোকাবেলার ধরনেও থাকতে হবে ব্যতিক্রম। বাংলাদেশেও পূর্বে অনেক দূর্যোগ হয়েছে। ২০০৭ সালের সিডর দক্ষিণাঞ্চলে বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। কিন্তু দেশের বাকি অঞ্চল স্বাভাবিক থাকায় সংকট উত্তরণ সহজ হয়েছে।

করোনা একসাথে সারা দেশে আঘাত করার কারণে খাদ্য সংকট, অর্থ সংকট আসন্ন বলে মনে হচ্ছ। উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। রেমিটেন্স কম আসবে, কারণ প্রবাসীরা নিজেরাও থাকবেন সংকটে। রপ্তানি আয় কমে যাবে, কারণ রপ্তানমূখী শিল্পগুলোর উৎপাদনও বন্ধ। আমাদের পোষক শিল্প তো বন্ধই। সুতরাং চতুর্মুখী একটা সংকটে আমরা পড়তে যাচ্ছি।

বহির্বিশ্বও নিজেদের চিন্তায় ব্যস্ত থাকবে। সাহায্য সহযোগিতা আসবে না আগের মত। কারণ পুরা বিশ্বই মহামন্দার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকার অনেক পদক্ষেপ নিচ্ছে। ইতোমধ্যে কৃষক, গার্মেন্টস শিল্পের জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে। ছোট বড় সব ক্ষেত্রেও প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

তবে মহামারি যদি দীর্ঘমেয়াদি হয় তাহলে এসব প্রণোদনা কতটা কাজে আসবে তা এখনই বলা মুশকিল।

দেশে বেকার সমস্যা সৃষ্টি হবে। কেননা ছোট খাটো ব্যবসায়ীই লোকসানের মুখোমুখি হয়েছে।

সরকারকে এখন কৃষির দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। সারা দেশের বোরোধান কাটার সময় হয়েছে। ধান কাটা লোকের অভাবে যাতে ফসল তুলতে কৃষকদের সমস্যা না হয়। একই সাথে ধান কাটতে গিয়ে যাতে আবার ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব না ঘটে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার চাইলে স্বেচ্ছাসেবী তৈরি করে প্রশিক্ষণ দিয়ে মাঠে নামাতে পারে।

আমাদের অনাবাদি জমি যাতে আগামীতে আর পতিত না থাকে তার জন্য পদক্ষেপ নিতে পারে।

বাসা বাড়ির ছাদ, উঠান সব জায়গায় পারিবারিকভাবে শাক সবজির চাষ করার বিষয়ে উৎসাহ দেয়ার পাশাপাশি বাড়ির পুকুর, দিঘিতে মাছের চাষ বাড়ানো যেতে পারে।

এ মহামারি থেকে দ্রুতই রক্ষা পাক বিশ্ব, এটাই কামনা। এর দীর্ঘসূত্রিতার উপর আমাদের সংকটের তীব্রতা নির্ভর করছে।

অসহায় মানুষদের সহযোগিতায় সরকারের পাপাশি সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে এসেছে। করোনার চেয়ে খাদ্য সংকটে যেন আমাদের বেশি সমস্যায় পড়তে না হয় সেদিকে জোর দিতে হবে। আল্লাহ মানবজাতিকে অবশ্যই রক্ষা করবেন। তবে সচেতনতাও আমাদের অনকেটা রক্ষা করতে পারে।

লেখক: এম এ হাসান, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, ইচ্ছেঘুড়ি ফাউন্ডেশন।

প্রিয় পাঠক, ভিন্নমতে প্রকাশিত লেখার বিষয়বস্তু, রচনারীতি ও ভাবনার দায় একান্ত লেখকের। এ বিষয়ে টোয়েন্টিফোর লাইভ নিউজপেপার কোনোভাবে দায়বদ্ধ নয়। ধন্যবাদ।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর