আপনি পড়ছেন

সৃষ্টিকর্তা তাকে দৃষ্টিশক্তি দিয়েও তা অল্প বয়সেই কেড়ে নেন। তাই বলে থেমে থাকেননি। বাকি মানুষের মতো এ নিয়ে কখনো মন খারাপও করেননি। চেষ্টা করেছেন একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো বেঁচে থাকার। বরং আমরা একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ হয়েও যা করতে ভয় পাই, ওই মানুষটা সেই কাজ নির্ধিদ্বায় করে ফেলেন।

erik weihenmayer2এরিক ওয়েহেনমায়ার

বলছি বিশ্বের সর্বপ্রথম এবং একমাত্র দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মাউন্ট এভারেস্ট জয়ী এরিক ওয়েহেনমায়ারের কথা। তাকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বলাটা ঠিক উচিত হবে না মনে হয়। কারণ প্রকৃত প্রতিবন্ধী তারাই, যারা যেকােনাে কাজে ভয় পায়। সাহসের অভাবে মাঝেমধ্যে অনেক সহজ কাজও করতে পারে না।

কিন্তু এই মানুষটি একাধারে অ্যাথলেট, অ্যাডভেঞ্চারার, লেখক, সমাজকর্মী এবং মোটিভেশনাল স্পিকার। বিশ্বের একমাত্র দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হিসেবে জয় করেছেন পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পর্বত শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টসহ সাত মহাদেশের উঁচু পর্বত শৃঙ্গগুলো। যেটিকে সেভেন সামিট বলা হয়ে থাকে। পাশাপাশি পশ্চিম পাপুয়া নিউ গিনিতে অবস্থিত ওশেনিয়া অঞ্চলের দীর্ঘতম শিখর কার্সটেনস পিরামিডও জয় করেন।

গল্পের শুরু

গল্পের শুরুটা ১৯৬৮ সালে। সে বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সি অঙ্গরাজ্যের প্রিন্সটনে জন্মগ্রহণ করেন এরিক ওয়েহেনমায়ার। জন্মের সময় তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক ছিলেন। কিন্তু বিপত্তি বাধে জন্মের ১৫ মাস বয়সে গিয়ে। তখন তার শরীরে জুভেনাইল রেটিনোসকাইসিস নামক বিরল রোগ বাসা বাঁধে। এর প্রভাবে ধীরে ধীরে দৃষ্টিশক্তি হারাতে থাকে এরিক। যার ফলে মাত্র ১৪ বছর বয়সে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যেতে হয়।

erik weihenmayerএরিক ওয়েহেনমায়ার

হার না মানা ইচ্ছা শক্তি

তাই বলে ছোট্ট এরিক থেমে থাকেনি। তখন তার মধ্যে রেসলিং খেলার প্রতি তীব্র আগ্রহ জন্মে। অন্ধ বলে প্রথমে তাকে কেউ দলে নিতে চায়নি। কিন্তু তীব্র আগ্রহ দেখে তাকে দলে যুক্ত করেন স্কুল কোচ। পরবর্তীতে স্কুলের সবচেয়ে সেরা রেসলার এবং অধিনায়ক নির্বাচিত হন। স্কুলে থাকাকালীন অংশগ্রহণ করেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ফ্রি-স্টাইল রেসলিং চ্যাম্পিয়নশিপে।

মাত্র ১৬ বছর বয়সেই তার মধ্যে পর্বতারোহণ করার আগ্রহ জন্মে। সেটির জন্য তখন থেকেই অনুশীলন শুরু করেন। এক পর্যায়ে সুযোগও এসে যায়। একদিন এক নিউজ লেটারের মাধ্যমে জানতে পারেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে রক ক্লাইম্বিংয়ে (পর্বতারোহণ) যাবে একটি দল। সঙ্গেসঙ্গেই নিজের নামটি নিবন্ধন করে ফেললেন তিনি। এই সুযোগ যে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো। তাই নাম নিবন্ধন করতে এক মুহূর্তও দেরি করেননি।

পরবর্তীতে রেসলিং এবং মাঝেমধ্যে অ্যাডভেঞ্চার করেই জীবন কেটে যাচ্ছিল এরিকের। এর মধ্যে বোস্টন কলেজ থেকে 'ডবল মেজর' নিয়ে ইংরেজিতে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। সেই সুবাদে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং একই স্কুলের রেসলিং কোচও হন। একই সঙ্গে নিজের পর্বতারোহণের অনুশীলনটাও নিয়মিত চালিয়ে যান। একপর্যায়ে অ্যারিজোনা পর্বতারোহী নামক স্থানীয় একটি ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত থেকে অনুশীলন শুরু করেন।

erik weihenmayer3এরিক ওয়েহেনমায়ার

স্বপ্ন জয়ের শুরু

বলিউড বাদশাহ শাহরুখ খানের এক বিখ্যাত ডায়লগ আছে। 'ওম শান্তি ওম' মুভিতে বলা সেই ডায়লগটি হলো, 'যদি তুমি কোনো কিছু মন থেকে চাও, তাহলে পুরো পৃথিবী সেই জিনিসকে তোমার সঙ্গে মিলানোর জন্য চেষ্টায় লেগে যায়।' এরিকের বেলায়ও সেই ডায়লগটি মিলে যায়। দীর্ঘ অপেক্ষার পর প্রথমবার তার সামনে কোনো পর্বত শৃঙ্গ জয়ের সুযোগ এসে যায়।

১৯৯৫ সালে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২০ হাজার ৩১০ ফুট উঁচু উত্তর আমেরিকার সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ 'ডিনালি' জয় করেন তিনি। এটি বিশ্বের সাত মহাদেশের সাতটি সর্বোচ্চ শৃঙ্গের মধ্যে তৃতীয়। আর্কটিক চক্রের আলাক্সা পর্বতশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত এ পর্বতে প্রায় সবসময়ই ভারি তুষারপাত, তীব্র ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝটকা এবং জমে যাওয়ার মতো আবহাওয়া থাকে। অভিযানকালে বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়ে ২৪ দিনের বিরতি শেষে সহযাত্রীরা প্রায় সবাই হাল ছেড়ে দেয়। কিন্তু এরিকের জেদ আর দুঃসাহসিক মনোবল তাকে চূড়ায় উঠতে সাহায্য করে।

ওই অভিযানকালে মাঝপথে এক সহযাত্রী তীব্র ঠাণ্ডা সইতে না পেরে মৃত্যুবরণ করেন। এমনকি বরফে দীর্ঘদিন ঢাকা পড়ে থাকা মৃতদেহগুলোও তাকে দমাতে পারেনি। তীব্র প্রতিকূল পরিবেশেও 'ডিনালি' জয় করার পর তার মধ্যে নতুন অভিজ্ঞতার সঞ্চার হয়। সেই ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালে জয় করে ফেলেন বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু পর্বত শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট।

erik weihenmayer1এরিক ওয়েহেনমায়ার

মিশন এভারেস্ট

এই পর্বত শৃঙ্গ জয় করা এরিকের জন্য মোটেও সহজ ছিল না। নিতে হয়েছিল সর্বোচ্চ প্রস্তুতি। একে তো বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু পর্বত শৃঙ্গ। তার ওপর মৃত্যু ঝুঁকিতো ছিলই। সবমিলিয়ে দৃষ্টিহীনতাকে পাত্তা না দিয়ে কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেকে এভারেস্ট জয়ের জন্য প্রস্তুত করে তোলেন। প্রস্তুতি শেষে ২০০১ সালে সহযাত্রীদলের সঙ্গে এভারেস্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। প্রথমে কাঠমান্ডু যাওয়ার পর মানুষকে বিশ্বাসই করাতে পারছিলেন না যে, তিনি এভারেস্ট জয় করতে এসেছেন।

দৃষ্টিহীন হওয়াতে প্রথমে কোনো শেরপা তার সঙ্গে যেতে রাজি ছিলেন না। পরবর্তীতে বহু কষ্টে বোঝানোর পর তারা যেতে রাজি হন। তারপরও অনেকেই তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন। সবার একটাই কথা ছিল, অন্ধ মানুষ কীভাবে আবহাওয়া, তুষারপাত কিংবা বায়ুপ্রবাহের রকম-সকম নির্ণয় করতে পারবেন। এক্ষেত্রে ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু এরিক জানতেন, তার অনুভূতি ক্ষমতা কতটা শক্তিশালী।

অবশেষে বহু ত্যাগ-তিতীক্ষার পর ২০০১ সালের ২৫ মে মাউন্ট এভারেস্টের সর্বোচ্চ চূড়ায় পা রাখেন এরিক ওয়েহেনমায়ার। সেই অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, যখন চূড়ার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছি সেই সময়টা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ভয়ংকর। একদিকে নিজের ভেতরে দুরু দুরু ভাব, অন্যদিকে সহযাত্রীরা নানা রকম দিক-নির্দেশনা দিচ্ছিল। কেউ বলছিল, এইদিক দিয়ে দুই পা গেলেই শৃঙ্গ, আবার কেউ বলছে, আর দশ পা গেলে সর্বোচ্চ চূড়া।

erik weihenmayer4মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় এরিক ওয়েহেনমায়ার

সেই অভিযাত্রার পর বিশ্ব বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন তাকে নিয়ে একটি কভার স্টোরি করেছিল। সেখানে উল্লেখ করা হয়, 'এরিক যা করেছেন তা দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখার কোনো উপায় নেই। কারণ এর আগে কেউ কখনো এমনটা করেনি। এটি এমন একটি অনন্য অর্জন, যা সত্যিকার অর্থে মানুষকে তার সীমাবদ্ধতার বাইরে এনে সক্ষম করে তোলে।'

পরবর্তীতে সাত মহাদেশের বাকি ৫টি সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গও জয় করেন তিনি। ২০০৪ সালের মধ্যে এগুলো জয় করেন। বর্তমানে এরিক একজন জনপ্রিয় মোটিভেশনাল স্পিকার। পাশাপাশি নিজের অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে বই লিখেছেন। আছে নিজের একটি ওয়েবসাইট। সেখানে গেলে তার সম্পর্কে আরো অজানা অনেক কিছুই জানা যাবে।