শাহেদের নিষ্ঠুরতার জীবন্ত সাক্ষী তিনি

করোনারোগীদের ভুয়া রিপোর্ট দেয়া ও তাদের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেয়াসহ নানা অভিযোগে গ্রেপ্তার রিজেন্ট হাসপাতালে মালিক মো. শাহেদ করিমের একের পর এক অপকর্মের কথা বেরিয়ে আসছে। পান থেকে চুন খসলেই কর্মচারীদের ওপর নির্যাতন করতেন তিনি। তার নির্যাতনের শিকার হয়ে বর্তমানে পঙ্গুত্বের জীবনযাপন করছেন এক নিরাপত্তাকর্মী।

ভুক্তভোগী নিরাপত্তাকর্মী জাহিদ ও রিজেন্টের মালিক শাহেদ (ডানে)

শুধু পঙ্গুত্বই নয়, ভুক্তভোগী ওই নিরাপত্তাকর্মী শাহেদের নির্যাতনের শিকার হয়ে করেছেন কারাভোগ এবং হারিয়েছেন বেঁচে থাকার সম্বল বাপ-দাদার জমিও। মো. জাহিদ নামের ৪৭ বছর বয়সী ওই নিরাপত্তাকর্মীর বাড়ি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলায়। দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করা জাহিদ এক সময় সিলেট সিটি কর্পোরেশনে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। তখন সিলেটের মেয়র ছিলেন বদরউদ্দিন আহমেদ কামরান।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ভুক্তভোগী জাহিদ বলেন, ২০০৭ সালে মেয়রের বিরুদ্ধে সিলেটের কিচেন মার্কেট মামলা হয়। সে সময় মেয়রের সঙ্গে দেখা করতে সিলেট গিয়েছিলেন শাহেদ। তখনই তার সঙ্গে পরিচয় হয়। শাহেদ আমাকে একটা ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বলেন, চাকরি লাগলে যেন তাকে ফোন দেই। এরপর মেয়র গ্রেপ্তার হলে আমার চাকরি চলে যায়। তারপরও সিলেটে থেকেই টুকটাক কাজ করতাম।

২০১৭ সালের জানুয়ারিতে শাহেদের দেয়া ভিজিটিং কার্ডের নম্বরে ফোন দিয়ে চাকরি চান জাহিদ। তখন মোটা অংকের বেতনের আশ্বাস দিয়ে তাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন শাহেদ। ঢাকায় আসার পর শাহেদ তাকে ২৫ হাজার টাকা বেতনে প্রধান নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে চাকরি দেন। পাশাপাশি এটাও বলে দেন, আগে এক লাখ টাকা জামানত দিয়ে চাকরি কনফার্ম করতে হবে।

শাহেদের আশ্বাসে জাহিদ বাড়িতে গিয়ে বাপ-দাদার ৫ শতাংশ জমি আড়াই লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন। সেখান থেকে এক লাখ টাকা ঢাকায় এনে শাহেদের কাছে জমা দেন। এরপর ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই রিজেন্ট হাসপাতালের মিরপুর শাখায় প্রধান নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে যোগ দেন জাহিদ।

যোগদানের পর থেকেই জাহিদ দেখতে পান, শাহেদ স্টাফদের সঙ্গে কথায় কথায় খারাপ ব্যবহার করেন, কাউকে কাউকে মারধরও করেন। এসব দেখে এক মাস পর হাসপাতালের ম্যানেজারকে গিয়ে চাকরি ছেড়ে দেয়ার কথা জানান জাহিদ। তখন ম্যানেজার এ কথা শাহেদকে জানালে লিখিত অব্যাহতিপত্র দিতে বলা হয়। কথামতো লিখিত অব্যাহতিপত্র জমা দিয়ে বেতন ও জামানতের টাকার জন্য ঢাকায় থাকেন জাহিদ।

পরে ১৩ মার্চ বেতন ও জামানত আনার জন্য রিজেন্ট হাসপাতালে গেলে হাসপাতালের ম্যানেজার ও দুজন ব্যক্তি মিলে তাকে শাহেদের কক্ষে নিয়ে আটকে রাখে। কিছুক্ষণ পর শাহেদ এসে জাহিদের পিঠে ও কোমরে মেডিকেলের হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে অজ্ঞান করে ফেলেন। এরপর পল্লবী থানায় খবর দিয়ে জাহিদকে চুরির মামলায় ফাঁসিয়ে দেন শাহেদ। থানায় নিয়ে পুলিশ তাকে ফের মারধর করে।

এভাবে দুই মাস কারাগারে থাকার পর জামিনে বের হয়ে বাড়ি ফিরে যান ভুক্তভোগী ওই নিরাপত্তাকর্মী। ২০১৭ সালের শেষ দিকে আবারও ঢাকায় আসেন জাহিদ। মেরুদণ্ডের আঘাতের কারণে তিনি কুঁজো হয়ে যান। ঢাকায় এসে মিরপুরের স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লার ভাই আশিক মোল্লার সঙ্গে দেখা করে সবকিছু খুলে বলেন। তখন সাংসদের ভাই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে কিছু টাকাও দিয়ে দেন।

চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেলেও পল্লবী থানা পুলিশ তার বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। সে জন্য বার বার ঢাকায় এসে হাজিরা দিতে হতো জাহিদকে। উকিলের কাছে পুরো ঘটনা খুলে বলায় কোনো ফি দিতে হতো না। ২০১৮ সালের শুরুর দিকে জাহিদের আইনজীবী পুরো ঘটনা ঢাকার সিএমএম আদালতে খুলে বলেন। এরপর বিচারক জাহিদকে খাস কামরায় নিয়ে পুরো বক্তব্য রেকর্ড করেন এবং মামলা থেকে অব্যাহতি দেন। এমনকি তার দুর্দশা ও দরিদ্রতার কথা শুনে বিচারক তাকে কিছু টাকা-পয়সা দিয়েও সহযোগিতা করেন।