চীন-ইরান চুক্তিতে আসছে রাশিয়া, পাল্টাবে ভূ-রাজনৈতিক চিত্র

চীন ও ইরানের মধ্যে ২৫ বছরের একটি 'কৌশলগত সহযোগিতা' চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে যাচ্ছে। আর এ চুক্তিতে নতুন করে যুক্ত হতে যাচ্ছে রাশিয়া। সম্প্রতি রাশিয়া সফরকালে দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ। যদি এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তাহলে মধ্যপ্রাচ্য তথা এশিয়ার বিরাট একটি অংশের ভূ-রাজনৈতিক চালচিত্র আমূলে বদলে যাবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের আরো অনেক দেশও চীনের সঙ্গে হাত মেলাতে পারে।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং (মাঝে) ও ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি

নিউইয়র্ক টাইমস, তেহরান টাইমস এবং হংকং-ভিত্তিক এশিয়া টাইমসসহ বেশ কিছু গণমাধ্যমের বরাতে জানা গেছে, এই চুক্তির মাধ্যমে ইরানের তেল-গ্যাস, ব্যাংকিং, টেলিকম, বন্দর উন্নয়ন, রেলওয়ে উন্নয়ন এবং আরো ডজন খানেক গুরুত্বপূর্ণ খাতে চীন বিনিয়োগ করবে। এভাবে আগামী ২৫ বছরে অন্তত ৪০ বিলিয়ন ডলারের মতো বিনিয়োগ করবে তারা। সামরিক ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যৌথ প্রশিক্ষণ মহড়া, গবেষণা, যুদ্ধাস্ত্র তৈরি এবং গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানের কথাও চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

মার্কিন ডলারের প্রভাব কমবে এবং চীন-ইরানের মুদ্রার প্রভাব আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়বে

এ ছাড়া চুক্তির আওতায় চীন ও রাশিয়া তাদের বিনিয়োগের সুরক্ষায় ইরানে বিপুল সংখ্যক সৈন্য মোতায়েন করতে পারবে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে এই প্রথম সরাসরি চীনা ও রাশিয়ান সামরিক উপস্থিতির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে জ্বালানি কেনার ক্ষেত্রে চীনকে অনেক ছাড় দেবে ইরান। তারা অনেক কম মূল্যে তেল-গ্যাস চীনে রপ্তানি করবে। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বের তেল ও গ্যাস খাতের ভারসাম্যে মৌলিক পরিবর্তন আসবে। যেখানে লেনদেনের ক্ষেত্রে মার্কিন ডলারের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। দেশ তিনটি নিজেদের মুদ্রা ব্যবহার করবে।

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি

বিশ্লেষকরা বলছেন, এ চুক্তির মধ্য দিয়ে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মোকাবেলা করে অর্থনৈতিকভাবে আরো শক্তিশালী হয়ে উঠবে ইরান। মোটকথা, আগামী বছর থেকে এটি বাস্তবায়ন শুরু হলে এক দশকের মধ্যে দেশটির চেহারা সম্পূর্ণ বদলে চীন বা দক্ষিণ কোরিয়া বা পশ্চিমা দেশগুলোর পর্যায়ে চলে যাবে। পাশাপাশি ইরানের জ্বালানি তেল-গ্যাস খাতের একমাত্র ক্রেতা হতে পারবে চীন। এতে করে আন্তর্জাতিক বাজারে হারানো অর্থ ফিরে পাবে তারা। তাছাড়া চীন চাচ্ছে ইরান তাদের সাফল্যের প্রতীক হোক। যেন পরবর্তীতে অন্যান্য দেশও চীনের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তিতে আবদ্ধ হতে উৎসাহ পায়।

মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন প্রভাব কমবে এবং চীন-ইরান ও রাশিয়ার প্রভাব বাড়বে

অন্যদিকে, এ চুক্তির ফলে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মার্কিন কৌশলের হাত থেকে সুরক্ষিত থাকবে তেহরান। কারণ তাদের এই ভূ-রাজনৈতিক চুক্তির মূল বিষয় হলো সামরিক বাহিনী এবং ইরানে চীনা ও রাশিয়ান উপস্থিতি। ফলে এখন ইরানকে কেউ সামরিকভাবে আক্রমণ করতে চাইবে না। আরব উপসাগরে ও সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে প্রবেশাধিকার পাবে চীন-রাশিয়া।

চুক্তির আওতায় পাকিস্তান হয়ে চীন ও ইরানের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এ প্রকল্পে নৌ ও স্থল খাতে মোট ১৫টি কমন সীমান্ত পয়েন্ট রয়েছে দেশ দুটির মধ্যে। তাছাড়া আগে থেকেই আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, ইরাক, পাকিস্তান, তুরস্ক ও তুর্কমেনিস্তানের সঙ্গে সড়ক এবং রাশিয়া ও কাজাখস্থান ও সমগ্র আরব উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সমুদ্রপথে যোগাযোগ রয়েছে ইরানের। আর চীনের সঙ্গে মোট ১৫টি দেশের সংযোগ আছে। এখন এ চুক্তি হলে নতুন করে কয়েক ডজন এশীয় দেশ সম্পৃক্ত হবে।

বিশ্লেষকরা যা বলছেন

এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয় গবেষক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক শিরিন হান্টার মিডল-ইস্ট আইতে এক নিবন্ধে বলেছেন, এই চুক্তির ফলে মধ্যপ্রাচ্যে চীনের অবস্থান আরো শক্তিশালী হবে। এতে করে ইরানের অর্থনীতিরও ব্যাপক উন্নতি হবে। তাদের রাজনীতি আরো স্থিতিশীল হবে। তাছাড়া ইরানের সঙ্গে সংঘাতের ব্যাপারে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর আগ্রহ কমে যাবে। এমনকি অনেক দেশই চীনের সঙ্গে এই ধরনের বিশেষ চুক্তিতে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে।

আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক কাবেহ আফছার সারসাইয়াবির বরাত দিয়ে বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়, এ চুক্তির ফলে অঞ্চলটির ভূ-রাজনীতির কৌশলগত সমীকরণ বদলে যাবে। খুব ধীরে হলেও নিশ্চিতভাবে চীন-ইরান এবং পাকিস্তানের মধ্যে একটি কৌশলগত জোট দানা বাঁধছে। যার সঙ্গে অদূর ভবিষ্যতে আফগানিস্তান, ইরাক এবং সিরিয়া যুক্ত হতে পারে। নতুন এই ভূ-রাজনৈতিক সম্ভাবনা যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠবে।