ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব: সৌদি আরব-পাকিস্তান সম্পর্কে ফাটল!

সৌদি আরবের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক ক্রমশ খারপের দিকে যাচ্ছে। এর নেপথ্যে যতটা না কাশ্মির ইস্যু, তার চেয়ে বেশি এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। দেশদুটির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের ‘অকৃত্রিম বন্ধু’ হিসেবে পরিচিত। অপরদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠতা বেশি।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এবং সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান

বিশ্লেষকরা বলছেন, কাশ্মির ইস্যুতে পাশে থাকার জন্য সৌদি সরকারকে বারবার আহ্বান করেছিল পাকিস্তান। কিন্তু ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে পাত্তা দেয়নি সৌদি আরব। ধারণা করা হচ্ছে- এরপর থেকেই মূলত দেশদুটির মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হতে শুরু করে। তাছাড়া চির বৈরী ভারতের সঙ্গে সৌদির বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা ভালোভাবে নিতে পারেনি পাকিস্তান সরকার।

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা প্রসঙ্গসহ মুসলমানদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুতে সৌদি আরবের নীরব ভূমিকাও এক্ষেত্রে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। এমতাবস্থায় ইরান, চীন, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, কাতারসহ যারা কাশ্মির ইস্যুতে পাকিস্তানকে সমর্থন দিচ্ছে তাদের নিয়ে নতুন একটি জোট গড়ারও ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এই দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ততোটা মজবুত নয়।

বিবিসি বাংলার খবরে বলা হয়েছে, গত বছর সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ইসলামাবাদ সফরে দেশদুটির মধ্যে সম্পর্কের নতুন এক মাত্রার ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। সে সময় সৌদি আরব ও পাকিস্তানের মধ্যে শত শত কোটি ডলারের বাণিজ্য এবং বিনিয়োগও চুক্তি সম্পাদিত হয়। কিন্তু বছরখানেকের ব্যবধানে তাদের সম্পর্ক মুখ থুবড়ে পড়েছে।

সম্প্রতি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কোরেশীর এক বক্তব্যে এর প্রমাণ মেলে। সৌদি আরবের কড়া সমালোচনা করে তিনি বলেন, পাকিস্তান বিশেষভাবে চেয়েছিল কাশ্মির ইস্যুতে সৌদি আরব তাদের সমর্থন দিক। পাশাপাশি ভারতের ওপর চাপ তৈরি করুক। কিন্তু সৌদি সরকার এ ইস্যুকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে দেখেছে।

এমনকি সৌদি আরবের অনিচ্ছার কারণেই ওআইসি কাশ্মিরের ওপর একটি জরুরি বৈঠক ডাকা নিয়ে পাকিস্তানের প্রস্তাবে কান দেয়নি মন্তব্য করে কোরেশী বলেন, ওআইসিকে বিনীত অনুরোধ করা হয়েছিল যেন তারা কাশ্মির ইস্যু নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নিয়ে একটি কাউন্সিল ডাকে। কিন্তু তারা সেটা করেনি।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়, দেশ দুটির মধ্যে সম্পর্ক এখন এতোটাই খারাপ পর্যায়ে আছে যে, ২০১৮ সালে পাকিস্তানকে দেয়া ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার জরুরি ঋণ সহায়তা থেকে ১০০ কোটি ডলার দ্রুত ফেরত চেয়েছে সৌদি। ইতোমধ্যে পাকিস্তান সেই টাকা পরিশোধ করেছে বলেও জানা গেছে। এ ছাড়া জ্বালানি তেল আমদানির জন্য ৩২০ কোটি ডলারের যে ক্রেডিট লাইন সৌদি আরব পাকিস্তানের জন্য অনুমোদন দিয়েছিলো, সেটির মেয়াদ বৃদ্ধির সিদ্ধান্তও হিমঘরে ঢুকে গেছে।

বিভিন্ন সূত্র বলছে- পরিস্থিতি সামাল দিতে কয়েকদিন আগে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়াকে সৌদি পাঠানো হয়, কিন্তু তাতে তেমন একটা কাজ হয়নি। এমনকি যুবরাজ বিন সালমান তাকে সাক্ষাৎ দেননি।

এ বিষয়ে দিল্লির জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদোয়াজ বলেন, কাশ্মির ইস্যু নয়, বরং সৌদি আরব ও পাকিস্তানের সম্পর্কের টানাপড়েনকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট হিসেবে দেখতে হবে। চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বৈরিতাকে কেন্দ্র করে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্কে যে অদলবদল চলছে, সে কারণেই তাদের সম্পর্কে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।

তিনি বলেন, সৌদি আরব আগাগোড়া যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র। পাশাপাশি তারা বহুদিন ধরেই মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বে। কিন্তু বর্তমানে সেই প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। চীন চাইছে মুসলিম বিশ্বে সৌদির গুরুত্ব কমে যাক। তাই তারা ইরান, তুরস্ক, মালয়েশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে। আর আগে থেকেই পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের ভালো সম্পর্ক। সম্প্রতি চীন-পাকিস্তানের ইকোনমিক করিডরে ইরানের অন্তর্ভুক্তিও সৌদি আরব পছন্দ করছে না।