ইরান-চীন সম্পর্কে ‘আতঙ্কিত’ ভারত
- Details
- by আন্তর্জাতিক ডেস্ক
সাম্প্রতিক সময়ে ইরানের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের পারদ সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছে বলে মনে করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে দুই দেশ দীর্ঘ বছরের একটি চুক্তিও প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছে। নিজেদের একটি চরম শত্রু দেশ চীনের সঙ্গে পুরনো বন্ধু ইরানের এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে ভারত। শুধু তাই নয়, আরেক আজন্ম শত্রু পাকিস্তানের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক বৃদ্ধি দেশটির জন্য বাড়তি মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এমনই প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি ভারতের দুই মন্ত্রী আলাদাভাবে ইরান সফর করেছেন।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির সঙ্গে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের (মাঝে) বেঠক, পাশে উপস্থিত ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি (বামে)
জানা যায়, ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর গত সপ্তাহে অনেকটা নীরবেই তেহরান সফর করেছেন। মস্কোতে সাংহাই সহযোগিতা জোটের বৈঠকে যোগ দিতে যাওযার পথে তেহরানে নামেন রাজনাথ সিং। অন্যদিকে, মস্কো থেকে ফেরার পথে গত মঙ্গলবার তেহরানে নামেন জয়শঙ্কর এবং সারাদিন সেখানে অবস্থান করেন।
ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়, রিফুয়েলিং তথা বিমানে তেল ভরার জন্য দুই মন্ত্রী তেহরানে নেমেছেন। কিন্তু ওই দুই মন্ত্রী দুবাই বা আবুধাবিতে জ্বালানি না ভরে তেহরান থেকে কেন নিলেন- তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক যেভাবে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে তাতে চরম উদ্বিগ্ন ভারত। আর সে কারণেই ওই দুই মন্ত্রী তড়িঘড়ি তেহরান সফর করেছেন।
সম্প্রতি তেহরান সফরে গিয়ে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর (ডানে) সাক্ষাৎ
এ ব্যাপারে ভারতের দিল্লির জওহারলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটির (জেএনইউ) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদোয়াজ বিবিসি বাংলাকে বলেন, চীনের সঙ্গে ইরানের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত যে সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে, তাতে মাথাব্যথা বাড়ছে ভারতের। কারণ ইরানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত গুরুত্ব ভারতের কাছে অপরিসীম। আর ভারত কোনোভাবেই সেটা হারাতে চায় না।
ভারতের কাছে ইরানের গুরুত্বের কারণ কী
সঞ্জয় ভরদোয়াজ বলছেন, ভারতের কাছে ইরানের গুরুত্ব বিশাল এ জন্য যে, আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার বাজারে ঢুকতে হলে তেহরানের সহযোগিতা দরকার। আর সে কারণেই ইরানের চাবাহার বন্দরের উন্নয়নে কাজ করছিল ভারত। এ ছাড়া ইরানি জ্বালানির প্রয়োজন তো আছেই। সেইসঙ্গে কাশ্মির ইস্যুতে ইরানের মতো একটি প্রভাবশালী মুসলিম দেশের রাজনৈতিক সমর্থনও ভারতের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। আর সে কারণেই ইরানের ব্যাপারে এত উদগ্রীব ভারত।
বিবিসি বলছে, এটা এখন স্পষ্ট যে, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমানে দ্রুত পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনীতিতে ভারত ও ইরান ভিন্ন দুই মেরুতে অবস্থান নিয়েছে। বিশেষ করে, ভারতের সবচেয়ে বড় শত্রু দেশ চীনের সঙ্গে ইরানের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত যে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হচ্ছে, ভারতের জন্য তা দুঃস্বপ্ন বললেও অত্যুক্তি হবে না।
ইরান ও ভারতের মধ্যে বর্তমানে দূরত্ব, তা কিন্তু একদিনে তৈরি হয়নি। বিগত ১৫ বছরে আমেরিকার সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক যত ঘনিষ্ঠ হয়েছে, বিপরীতে ইরানের সঙ্গে দূরত্ব ততই বেড়েছে। আর সেই শূন্যতার সুযোগ নিয়ে ইরানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করেছে চীন।
চীন-ইরানের ঐতিহাসিক চুক্তি
দীর্ঘ ২৫ বছর মেয়াদি একটি কৌশলগত সহযোগিতা চুক্তি প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছে চীন ও ইরান। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বলছে, এই চুক্তির আওতায় ইরানের তেল-গ্যাস, ব্যাংকিং, টেলিকম, বন্দর উন্নয়ন, রেলওয়ে উন্নয়ন এবং আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ খাতে চীন বিনিয়োগ করবে। আগামী ২৫ বছরে সেই বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়াবে কমপক্ষে ৪০ বিলিয়ন ডলার। এর অংশ হিসেবে চীন স্বল্প মূল্যে ইরানের জ্বালানি কিনতে পারবে।
এদিকে, কৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ ইরানের যে চাবাহার বন্দর উন্নয়নের কাজ ভারত শুরু করেছিল, সেই বন্দরের সম্প্রসারণ এবং বন্দরটির সঙ্গে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন শহরের রেল যোগাযোগের কাজ এখন চীনের হাতে তুলে দিতে যাচ্ছে তেহরান। এ ব্যাপারে ইরান ইতোমধ্যে সরকারিভাবে ঘোষণাও দিয়েছে। শুধু তাই নয়, বরং চীন এই চাবাহার বন্দরকে এখন চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের (সিপেক) অংশ করতে আগ্রহী বলে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে ভারতের সাবেক কূটনীতিক রাকেশ সুদ বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার শঙ্কায় মূলত চাবাহার বন্দর উন্নয়নে প্রতিশ্রুতি পূরণে গড়িমসি করেছে ভারত, যা ইরানকে ক্ষুব্ধ করেছে। সেইসঙ্গে যুক্ত হয়েছে এশিয়ায় জোট রাজনীতির আমূল পরিবর্তনের প্রভাব।
ভারতের এ কূটনীতিক বলছেন, মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে রাশিয়া ও চীন। এখন তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাকিস্তান, ইরান ও তুরস্ক। বিপরীতে ভারতের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের যেসব দেশের ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে, সেসব দেশ অর্থাৎ সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব ইরানের বড় শত্রু এবং যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু।
পাকিস্তান-ইরানের নতুন বন্ধুত্ব
এদিকে, চীনের আগ্রহে পাকিস্তানের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কে নতুন করে যে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হচ্ছে- তা ভারতের জন্য আরেক মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, আফগানিস্তানে ভবিষ্যতে ভারতের প্রভাব কতটা ধরে রাখা সম্ভব হবে, তা এখন অনেকটাই নির্ভর করছে ইরান ও পাকিস্তান মধ্যকার সম্পর্কের ওপর।
যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান উড্রো উইলসন সেন্টারের আয়োজনে গত মাসের শেষ দিকে পাকিস্তান নিয়ে এক ভার্চুয়াল আলোচনার আয়োজন করা হয়। তাতে অংশ নেন দেশটির প্রখ্যাত নিরাপত্তা বিশ্লেষক আয়েশা সিদ্দিকা। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণেই প্রধানত ইরানের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক স্থাপন নিয়ে পাকিস্তানের আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পাকিস্তানি এ নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের স্বার্থকে নতুন করে পর্যালোচনা করছে সৌদি আরব। আর সেখানে পাকিস্তানের চেয়ে ভারতকে তারা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। অন্যদিকে, পাকিস্তানের কাছে এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ইরান।
এ অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে যে, ভারত কি তাহলে তাদের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ মিত্র দেশ ইরানকে একেবারেই হাতছাড়া করে ফেলছে?
ভারতের দুই মন্ত্রী তেহরানে কেন?
এ ব্যাপারে নেহেরু ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদোয়াজ বলছেন, ভারতীয় মন্ত্রীর ইরান সফরে যুক্তরাষ্ট্র নাখোশ হবে- তা জেনেও দুই জন প্রভাবশালী মন্ত্রীকে তেহরানে পাঠিয়েছে নয়াদিল্লি। এর মাধ্যমে- ইরানের সঙ্গে সম্পর্ককে যে তারা কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে- সেটাই বোঝাতে চেয়েছে ভারত। নয়াদিল্লি এ বার্তাও দিতে চাইছে যে, পররাষ্ট্র নীতি এবং কৌশলগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারত এখনও স্বাধীন। এ ব্যাপারে তারা আপসহীন।
ইরানের জন্য ভারতের মতো একটি বৃহৎ বাজার সব সময়ই লোভনীয়। চীন যে তাদের জ্বালানি তেলের পুরোটাই কিনবে না, ইরান নিশ্চয়ই সেটা জানে। চীন ও আমেরিকার আধিপত্য তথা রেষারেষিকে কেন্দ্র করে এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে যে দলাদলি তৈরি হচ্ছে, ভারত ও ইরানের সম্পর্ক যে তার বলি হচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই,’ বলছেন অধ্যাপক ভরদোয়াজ।
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.