আপনি পড়ছেন

তাকওয়া অর্জনের জন্যই মহান আল্লাহ তা’য়ালা রোজা ফরজ করেছেন। ‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেয়া হল, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীদের দেয়া হয়েছিল। যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পারো। বাকারা ২: ১৮৩।

ramadan and taqwa imageপ্রতীকী ছবি

অতএব, আল্লাহপাক চান তাঁর মুমিন বান্দারা সিয়ামের অনুশীলনের মাধ্যমে তাকওয়া নামক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে।

মুমিন কারা

সাধারণভাবে মুসলমানের ঘরে জন্মগ্রহণ করলেই ধরে নেয়া হয় যে, সে মুসলিম ও মুমিন। কিন্তু এই চিন্তাধারা ইসলামসম্মতও নয়, বাস্তবসম্মতও নয়। কারণ সমস্ত মানবজাতি আদম (আ.) এর সন্তান। কিন্তু আমরা সব মানুষকে মুসলিম বলি না কেন?

জবাব হল- যে যে ধর্মমত বা আদর্শ অনুসরণ করে তাকে সেই ধর্মের অনুসারী বলে ধরে নেয়া হয়। তাই কেউ খৃষ্টান বা ইহুদী, হিন্দু বা বৌদ্ধ। এমনকি নবীর সন্তান বা স্ত্রী বা স্বজন হলেও নবীর দাওয়াতে অনুসারী না হওয়ায় তাকে তার অনুসারী হিসেবে ইসলামে বিবেচনা করা হয় না। তাই আমরা দেখি কুরআন মজীদে-

# নুহ (আ.) কে তার বিদ্রোহী সন্তানের জন্য দোয়া করতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন (সুরা হুদ :৪৫-৪৮)।

# নুহ (আ.) ও লুত (আ.) এর স্ত্রীরা তাদের স্বামীদের যথার্থ অনুসরণ না করায় তাদের জাহান্নামী বলে ঘোষণা করা হয়েছে। (তাহরীম ৬৬: ১০)।

# কারুন মুসা (আ.) এর আত্মীয়-স্বজনের অন্তর্ভুক্ত হলেও তার নাফরমানীর কারণে কারুন দুনিয়া ও আখিরাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। (কাসাস ২৮: ৭৬-৮২)।

# ইবরাহীম (আ.) এর পিতার ক্ষেত্রেও আমরা একই বিষয় দেখতে পাই। (তাওবা ৯: ১১৪)।

তাই, মুমিন হল তারাই যারা বুঝে শুনে স্বেচ্ছায় কালেমা তাইয়্যেবা কবুল করে নিয়েছে।

কালেমা তাইয়্যেবার তাৎপর্য

কালেমা তাইয়্যেবা হল- ‘‘লা ইলাহ ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ’’। অর্থ– নাই কোনো ইলাহ আল্লাহ ছাড়া এবং হযরত মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর রসুল।

এর তাৎপর্য হল-

প্রথমত, সকল মিথ্যা ইলাহকে বর্জন করে এক আল্লাহকে ইলাহ হিসেবে কবুল করে নেয়া।
মিথ্যা ইলাহ বা প্রভু হল:

# মানুষের নাফস যা মানুষকে আল্লাহর নাফরমানী করতে প্ররোচিত করে। (ফুরকান ২৫: ৪৩ এবং জাসিয়া ৪৫: ২৩)

# আত্মীয়তা ও বৈষয়িক বিষয় যেগুলি মানুষকে আল্লাহর প্রতি দায়িত্ব পালনে বাধা সৃষ্টি করে। (তাওবা ৯: ২৪)।

# ধর্মীয় ও সামাজিক নেতৃত্ব যা আল্লাহর বিধানের বিপরীত মনগড়া বিধানের দিকে মানুষকে পরিচালিত করে। (তাওবা ৯: ৩১)।

# টাকা-পয়সা-সম্পদ যা অর্জনে মানুষ হালাল হারামের বোধ হারিয়ে ফেলে। (বুখারী-২৮৮৭)।

দ্বিতীয়ত, আল্লাহকে ইলাহ হিসেবে মানার একমাত্র আদর্শ হিসেবে মুহাম্মাদ (সা.) এর কবুল করে নেয়া। (আলে-ইমরান ৩: ৩১, নিসা ৪: ৬৫)।

অতএব, কালেমা তাইয়্যেবার সারকথা হলো- আল্লাহর বিধানের আন্তরিক আনুগত্য এবং সেক্ষেত্রে একমাত্র মুহাম্মাদ (সা.) কে অনুসরণ করা। অর্থাৎ আল্লাহর বিধান আল-কুরআনকে রসুল (সা.) এর সুন্নাহ তথা সহীহ হাদীস অনুসারে মেনে চলা।

তাকওয়া কি?

তাকওয়া একটা গুণ। একে পরহেজগারীও বলা হয়। রসুল (সা.) তার নিজের বুকের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, তাকওয়ার স্থান অন্তরে। (মুসলিম-৪৭৪২)।

# তাকওয়ার অর্থ বেঁচে চলা, বেছে চলা, সতর্কতা অবলম্বন করা।

# আল্লাহর কাছে জবাবদিহি ও তাঁর শাস্তিকে ভয় কর আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত লাভের আশায় তাঁর যাবতীয় হুকুম-আহকাম পালন ও নিষিদ্ধ কাজগুলি বর্জন করার সদা জাগ্রত সচেতনতার নাম তাকওয়া।

# তাকওয়াকে আল্লাহ-ভীতি এবং ইংরেজীতে God consciousness বলা হয়।

তাকওয়া সৃষ্টি না হলে রোজার পরিণাম

আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, ‘‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও সে অনুযায়ী কাজ করা এবং জাহেলী কার্যক্রম বর্জন করলো না তার পানাহার পরিত্যাগে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। (বুখারী- ৬০৫৭)।

# তাই রসুল (সা.) এর হাদীসে ঈমান ও ইহতিসাব তথা আত্মসমালোচনা ও সওয়াবের অনুভূতি সহকারে রোজা রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

# উদ্দেশ্যবিহীন বা যথাযথ উদ্দেশ্য ছাড়া কোনো আমল করার ফায়দা পাওয়া সম্ভব নয়। তাই তাকওয়া অর্জনের উদ্দেশ্য ছাড়া সিয়াম পালন করে আমরা এর ফায়দা পাচ্ছি না। আমাদের সমাজে পরিশুদ্ধি আসছে না। সুদ, ঘুষ, ব্যভিচার, নারী নির্যাতন, বেহায়াপনা, দুর্নীতি, মানুষের অধিকার নষ্ট প্রভৃতি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

রোজ কিভাবে তাকওয়া সৃষ্টি করে?

রসুলুল্লাহ (সা.) এক হাদীসে বলেন, কিছু রোজাদার আছে যারা রোজায় ক্ষুধার কষ্ট ছাড়া অন্য কিছু লাভ করে না। আর কিছু তাহাজ্জুদগুজার আছে, যারা তাহাজ্জুদে রাত্রি জাগরণের কষ্ট ছাড়া অন্য কিছু লাভ করে না। (ইবনে মাযা, আহমাদ)।

# তাই রোজা কবুল হচ্ছে কিনা তা মূল্যায়ন করে দেখা খুবই জরুরী।

# অনেকেই প্রশ্ন করেন আমল কবুল হচ্ছে কিনা তা আমরা বুঝবো কিভাবে?

এ কথা সত্য, কারো আমল কবুল হচ্ছে কিনা তার প্রকৃত জ্ঞান রাখেন কেবল রব্বুল আলামীন। তথাপি আল্লাহ তা’য়ালা ও তাঁর রসুল সা. ইবাদতগুলির উদ্দেশ্য আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন। এর মধ্যে দুই ধরনের ফায়দা ও নেয়ামত রয়েছে।

প্রথমত: আমলগুলোর উদ্দেশ্য অবগত হওয়া

দ্বিতীয়ত: আমলগুলো কবুল হচ্ছে কিনা তা মূল্যায়নের এক ধরনের নির্দেশক হিসেবে কাজ করা।

যেমন- নামাজ প্রসঙ্গে আল-কুরআনে বলা হয়েছে- ‘‘নিশ্চয়ই নামাজ বান্দাকে অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে।’’ (আনকাবুত ২৯: ৪৫)

এখন যে বান্দা নামাজও পড়ছে আবার অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, বেপর্দা আচরণ ও বিভিন্ন কবীরা গুনাহয় অবলীলায় লিপ্ত হচ্ছে, তার নামাজে ঘোরতর ত্রুটি থেকে যাচ্ছে। তার উচিত হবে গভীরভাবে আত্মসমালোচনা করা এবং এ বিষয়ে ইলম অর্জন ও আত্মসংশোধনে উদ্যোগী হওয়া।

বস্তুত প্রতিটি আমলের একটি বাহ্যিক দিক আছে। আরেকটি হল তার অভ্যন্তরীণ বিষয় বা মূল উদ্দেশ্য, যেজন্য আল্লাহপাক তার বান্দাকে এর নির্দেশ প্রদান করেছেন। নির্ধারিত নিয়মে উঠা-বসা, তসবিহ যিকির প্রভৃতি আদায় করলে ফিকাহর দৃষ্টিতে নামাজ আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু নামাজীর চারিত্রিক সংশোধন না হলে তা কার্যত তাকে সামান্যই উপকার দিতে পারবে।

এজন্য রসুল (সা.) বলেন, ‘‘বান্দা নামাজ আদায় করে অথচ তার নামাজের ১০, ৯, ৮, ৭, ৬, ৫, ৪, ৩ অথবা ২ ভাগের ১ ভাগ মাত্র (কবুল বলে) লিপিবদ্ধ হয়।’’ (আবু দাউদ, নাসাঈ)

একই বিষয় রোজার ক্ষেত্রে। রোজার কিছু আনুষ্ঠানিকতা আছে। আবার কিছু হল তার অভ্যন্তরীণ বিষয় বা তার মূল উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য হাসিল না হলে হাদীস অনুযায়ী ক্ষুৎ-পিপাসা ও রাত্রি জাগরণের কষ্ট ছাড়া কিছুই লাভ হয় না। তাই বলে সিয়াম পালনে আমরা অবহেলা বা শিথিলতা করতে পারবো না। আমি তো অমুক অমুক গুনাহয় লিপ্ত আছি তাহলে রোজা করে কি লাভ- এ মনোভাব পোষণের সুযোগ নেই। বরং আল্লাহর নিকট তাওফীক প্রার্থনা ও অব্যাহত চেষ্টা করে যাওয়াই ঈমানের দাবি।

রোজা রেখে তাকওয়ার দিকে অগ্রসর হওয়া

প্রথমত: আল্লাহ পাক চান সিয়াম পালনের মাধ্যমে বান্দার মধ্যে আল্লাহর একনিষ্ঠ আনুগত্য সৃষ্টি করতে। তাই দেখুন, সিয়ামের সময় বাড়তি যা কিছু হারাম করা হল তা বস্তুত আল্লাহর হালাল করা কিছু কাজই।

দিনের বেলা

# হালাল খাদ্য-পানীয় বর্জন করা,

# বিবাহিত স্ত্রীর সাথে কামাচার বর্জন করা।

# আর রাতের বেলা অতিরিক্ত ও দীর্ঘ সলাতের মাধ্যমে আরাম-আয়েশের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা।

# এর থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, কতগুলো নির্দিষ্ট জিনিসের ওপর নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে আল্লাহ তাঁর বান্দাকে বাকী সব বিষয়ে তাঁর হুকুম পালনে অভ্যস্ত করতে চান।

# সেহরী-ইফতারের নির্দিষ্ট সময় মানার ব্যাপারে একই হিকমতা কাজ করছে। সুবহে সাদিক শুরু হয়েছে অতএব খাওয়া বন্ধ কর, আবার সূর্যাস্ত গেছে অবিলম্বে রোজা ভঙ্গ কর। এভাবে আল্লাহর নির্দেশ পালনে সতর্কতা ও তৎপরতা তৈরি করে রোজা।

দ্বিতীয়ত: কঠিন পরিস্থিতিতেও দুর্বলতম রোজাদার একান্ত গোপনেও রোজা ভঙ্গকারী কোনো কাজ করে না। রোজাদার জানে যে, আর কেউ না দেখলেও আল্লাহ তা’য়ালা অবশ্যই তার সব কাজ ও মনোভাব দেখছেন।

এভাবে দীর্ঘ এক মাস ২৪ ঘণ্টার যাবতীয় কাজে আল্লাহকে হাজির-নাজির জানা ও মানার মধ্য দিয়ে বান্দার মধ্যে সামগ্রিক জীবনের বাকী সব ক্ষেত্রে এবং সব সময় আল্লাহকে হাজির-নাজির মানার অভ্যাস তৈরি হয়।

জীবনের নানাবিধ টানাপোড়েনে এই সব ক্ষেত্রে যখন দুর্বলতা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয় তখন বছর ঘুরে আবার রোজা চলে আসে। বান্দা তার নৈতিক মনোবল ও দৈহিক ও রুহানী যোগ্যতাগুলি রিচার্জ করার সুযোগ পায়।

রোজার সময় দৃষ্টি, জবান ও মেজাজ প্রভৃতিতে নিয়ন্ত্রণ রাখার যে নির্দেশনা হাদীসে এসেছে তা বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয় যে, আল্লাহপাক চান বান্দা রোজা রেখে:

১. আল্লাহর প্রতি আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে উঠুক দেহের সাথে সাথে রুহও কল্যাণময় চিন্তা ও কাজে অভ্যস্ত হয়ে উঠুক।

২. আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজগুলি বর্জনে সতর্ক ও সক্রিয় হোক।

৩. আল্লাহর দেয়া নেয়ামত যেমন- চোখ, কান, অন্তঃকরণসহ যাবতীয় ইন্দ্রীয়গুলির উপর সংযম ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করুক।

৪. বান্দার মধ্যে আল্লাহর জন্য নিজের পছন্দ ও কাঙ্ক্ষিত বিষয় ত্যাগ করার শক্তি তৈরী হোক।

৫. আল্লাহর নির্দেশ পালনে তার মধ্যে কষ্টসহিষ্ণুতা সৃষ্টি হোক এবং এ ব্যাপারে সে হয়ে উঠুক সাবলিল ও স্বাচ্ছন্দ।

৬. আল্লাহর প্রতি আন্তরিকতা ও মহব্বত তৈরী হোক।

এভাবে রোজা বা সিয়াম বান্দার মধ্যে তাকওয়ার গুণ সৃষ্টিতে এক অনুপম হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অজ্ঞানতা ও অসচেতনতার কারণে আমরা এইসব মহান কল্যাণ থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছি। অনেকের রোজা কেবল ক্ষুৎ-পিপাসার কষ্টের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে।

মহান আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর বিধানসমূহের হিকমত ও উদ্দেশ্য উপলব্ধি করার এবং সেই মাফিক ইবাদত-বন্দেগীগুলি পালন করে সকলকে আত্মশুদ্ধি ও তাকওয়া অর্জনে তাওফীক দান করুন।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর