আপনি পড়ছেন

মানুষের অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য স্বার্থপরতা। যে বিষয়ে তার নগদ স্বার্থ দেখে না তাতে সে সহসা আকর্ষণ বোধ করে না। আধুনিক বৈষয়িক মানুষের জন্য তা আরো বেশি সত্য।

ramadan 2021 started bdপ্রতীকী ছবি

আল্লাহপাক রোজা ফরজ করেছেনই তাকওয়া অর্জনের জন্য। সহীহ হাদীস অনুযায়ী তাকওয়া অর্জন ব্যতিরেকে রোজা খুৎ-পিপাসায় কষ্ট ছাড়া কিছুই নয়। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে তাকওয়া আমাদের কেন প্রয়োজন? এর মধ্যে আমাদের কি ফায়দা আছে? এক মাস না খেয়ে থাকলাম, রাত জেগে নামাজ পড়লাম, তাতে কি বেহেস্ত পাওয়া যাবে না? তাকওয়া অর্জন করতে হবে, তা না হলে গোটা রোজা অর্থহীন কাজে পরিণত হবে?

আমরা সবাই আশা করি, আন্তরিকভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, আমাদের রোজাগুলি অবশ্যই আল্লাহ কবুল করবেন। গুনাহ-খাতা মাফ করে দিবেন। তবে আমাদের নিজেদের স্বার্থেই তাকওয়া অর্জন করা আমাদের জন্য জরুরী। বিষয়টি দীর্ঘ আলোচনা দাবী রাখে। তবে সংক্ষেপে এর উপর আলোকপাত করা হলো:

১) ভোগ-বিলাসের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ

রমজানের মৌলিক বিধান হল- সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত হালাল খাদ্য-পানীয় ও কামাচার থেকে বিরত থাকা। এ কথা সবাই জানি ও মানি যে, মাত্রাতিরিক্ত ভোগ-লিপ্সা থেকেই সমস্ত অপরাধ জন্ম লাভ করে। সবাই বুঝছি, মানছি দুর্নীতি আমাদের সমাজটা ধ্বংস করে দিচ্ছে। যার শক্তি আছে, ক্ষমতা আছে সেই তার থেকে দুর্বলের অধিকার হরণ করছে। নারী নির্যাতন ও তার ইজ্জত হরণ সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বা নারী অধিকারের বিষয়ে আলোচনা, কঠোর আইন দিবস পালন কিছুই কাজে আসছে না।

# আলোচনা সভা বা দিবস পালনে মানুষের স্বভাব পরিবর্তন বা উন্নত হয় না। কোনো দিন হয়ওনি।

# মানুষ তার স্বভাব পরিবর্তন করে তার সুখ আনন্দে লাগাম পড়ায় উন্নততর বিশ্বাস ও জীবনের প্রত্যাশায়।

# আর শুধু উন্নত বিশ্বাস ও কল্যাণের সম্ভাবনা থাকলেই হবে না, সেই অনুযায়ী অভ্যাস ও চরিত্র গঠনের বাস্তবসম্মত অনুশীলনের ব্যবস্থা থাকা জরুরী।

রমজানের মধ্যে এই উভয়বিধ ব্যবস্থা রয়েছে।

# সিয়াম পালনের মধ্যে স্রষ্টার আনুগত্য ও তাঁর সন্তুষ্টির ব্যবস্থা রয়েছে। আল্লাহ বলেন,

‘‘নিশ্চয়ই মুত্তাকীদের (তাকওয়ার অধিকারীদের) জন্য আছে সাফল্য।’’ (নাবা ৭৮: ৩১)।

আরো বলেন-

পক্ষান্তরে যে নিজ প্রতিপালকের সম্মুখে উপস্থিত হওয়ার ভয় রাখে এবং প্রবৃত্তি হতে নিজেকে বিরত রাখে, জান্নাতই হবে তার বাসস্থান। (নাযিয়াত ৭৯: ৪০-৪১)।

# অপরদিকে দীর্ঘ একমাস বৈধ পানাহার ও কামাচারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে যে অভ্যস্ত হয়। তার মধ্যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের দেহ ও মনের চাহিদা ত্যাগ করার আগ্রহ ও শক্তি প্রতিষ্ঠা হয়।

এটিই তাকওয়া। এহেন তাকওয়াবান মানুষ সাধারণভাবে দুর্নীতিতে লিপ্ত হয় না। অপরের অধিকার বিনষ্ট করে না। তার জন্য বৈধ নয়- এমন নারীকে কামনা করা তো দূরের কথা, সে কথা মনে করতেও ঘৃনা করে।

একটা সুন্দর সমাজের জন্য এ হেন পবিত্র চরিত্রের নারী-পুরুষ আমাদের প্রয়োজন। তাই সুন্দর ও কল্যাণময় সমাজ গঠনে তাকওয়ার বিকল্প নেই।

২) মিথ্যাচার বর্জনে তাকওয়া

রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, "যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা কথা বলে ও সে অনুযায়ী আমল-আচরণ এবং জাহেলী কর্মকাণ্ড বর্জন করতে পারল না, (রোজায়) তার খানা-পিনা ছেড়ে দেয়াতে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। (বুখারী: ৬০৫৭)।

কি কঠিন সতর্কবাণী! এক মাসের দীর্ঘ সিয়াম-কিয়াম সবই বিফলে যাওয়ার হঁশিয়ারি।

নবী (সা.) তো আর বাত কি বাত কথা বলেননি। নাউজুবিল্লাহ! রোজা রাখলে, কিয়ামুল লাইল করলে সব গুনাহ মাফ হবে তাতে তো শর্ত আছে:

-ঈমান ও ইহতিসাব (আত্মসমালোচনা ও আল্লাহর নিকট বিনিময় পাওয়ার আশা) সহকারে রোজা রাখতে হবে।

-ইহতিসাব ও আত্মসমালোচনার বিষয়ই হল রোজা রেখে মিথ্যাচার ও জাহেলি কর্মকাণ্ড কতটুকু বর্জন করলাম।

আচ্ছা মিথ্যাচার কোথায় কোথায় হচ্ছে একটু দেখি আমরা:

# সুদ, ঘুষ, মাপে-ওজনে কম দেওয়াসহ সব ধরনের হারামের উৎপত্তি মিথ্যার উপর। এজন্য বলা হয় মিথ্যা সকল পাপের মা।

# সকল প্রকার অধিকার হরণ তা স্ত্রীর দেনমোহর হোক বা বোনের সম্পদ অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ না করা।

# রাষ্ট্রীয় সম্পদ তসরুফ করা, ক্লাসে না পড়িয়ে শিক্ষকরা যখন কোচিং বাণিজ্য করেন কিংবা সাংবাদিকরা যখন হলুদ সাংবাদিকতার আশ্রয় নেন- এসব কিছুর মূলেই রয়েছে মিথ্যা।

# সমাজের দায়িত্বশীল মহল থেকে অধীনস্থ ও সাধারণ মানুষদের বিভ্রান্ত করার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া হয়।

# আদালতে বিচারককে বিভ্রান্ত করার জন্য দেয়া হয় মিথ্যা সাক্ষ্য অথবা দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারক অর্থের বিনিময়ে যে ভুল রায় দিচ্ছেন তার ভিত্তি মিথ্যা।

# মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজে এসব মানুষের অধিকংশই সারা বছর যাই করুক রমজান মাসে কিন্তু তারা রোজা রাখেন।

# এসবই অন্যায়-অপরাধ, সবাই জানি মানি, অন্তত নিজেরা যখন আক্রান্ত হই, তখন তো সবাই এসবের ক্ষতিকারকতা বুঝি। তবুও কেন এমন হচ্ছে?

# তাকওয়ার অভাব বা অনুপস্থিতি এর জন্য দায়ী। আর তাকওয়া অর্জনের উদ্দেশ্য ছাড়া আমরা যে রোজা রাখছি, তা আমাদের মাঝে সমাজ সংশোধনের অপরিহার্য এই গুণ সৃষ্টি করতে পারছে না।

# তাই নিজেদের প্রয়োজনে যথাযথভাবে ও আত্মসমালোচনা সহকারে রোজা রাখতে হবে আমাদের। প্রতিটি রোজা, প্রতিটি রমজান যেন অল্প অল্প করে হলেও আমাদের মাঝের এই দোষগুলি দূর করে।

# মনে রাখি, আমি আপনি না চাইলে কেউ আমাদেরকে পরিবর্তন করতে পারবে না। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এর কোনো মেকানিজম নেই। তার ইচ্ছাও কতটুকু আছে তা-ও প্রশ্নবিদ্ধ। তাই নিজেদের দুনিয়া ও আখিরাতের স্বার্থেই আমাদের তাকওয়ার চর্চা বাড়াতে হবে। তাকওয়াভিত্তিক জীবন গঠনে অগ্রসর হয়ে আসতে হবে। অন্যথায় মহান আল্লাহতা’লার সিদ্ধান্ত হলো-

‘‘অতঃপর যে সীমা লংঘন করে এবং পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দেয় নিশ্চয়ই জাহান্নামই হবে তার আবাসস্থল।’’ (নাযিয়াত ৭৯: ৩৭-৩৯)।

৩. সঠিক ও ভারসাম্যপূর্ণ জ্ঞানের জন্য তাকওয়া

আল্লাহপাক বলেন, ‘‘আল-হাক্কু মির রব্বিকুম।’’ ‘‘সত্য তোমার রবের তরফ থেকেই।’’ (বাকারা ২: ১৪৭)।

দুনিয়ার জীবনের যাবতীয় কাজে সঠিক দিক-নির্দেশনা ও সিদ্ধান্ত অপরিহার্য। কিন্তু মানুষের তৈরি ধ্যান-ধারণা ও মতবাদ তা দিতে চরমভাবে ব্যর্থ।

মানুষ নিজের জন্য ভারসাম্যপূর্ণ ও সকলের অধিকার নিশ্চিত করে এমন বিধান রক্ষায় বরাবর ব্যর্থ হয়েছে, ব্যর্থ হচ্ছে। মানবচরিত্রের দুটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য এর জন্য দায়ী।

প্রথমত: মানুষ স্বভাবতই স্বার্থপর। সে কোনো কর্তৃত্ব, অধিকার পেলেই নিজের, নিজের পরিবারের, গোষ্ঠী অথবা জাতির অনুকূলে স্বজনপ্রিয়তায় লিপ্ত হয়। অন্যের অধিকার নষ্ট করে; তাকে ধ্বংস করে হলেও সে নিজের ও স্বজনের অবৈধ স্বার্থ হাসিল করতে চায়।

দ্বিতীয়ত: মানুষের জ্ঞানগত সীমাবদ্ধতার কারণে অধিকাংশ সময় সে প্রান্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কখনো ব্যক্তিকে গুরুত্ব দিয়ে সামগ্রিক অধিকার লংঘন করে, আবার কখনো সমষ্টিকে খুশী করতে গিয়ে ব্যক্তির মৌলিক অধিকারগুলো কেড়ে নেয়।

তাই বিধান রচনার দায়িত্ব মহান স্রষ্টা আল্লাহ তা’আলা নিজের হাতেই রেখেছেন। বলেছেন- ‘‘সৃষ্টি যাঁর বিধান তাঁর’’। (আরাফ ৭: ৫৪)।

মানুষকে দুনিয়ায় প্রেরণের সময় তাকে প্রয়োজনমতো হেদায়াত, নিয়ম-নীতি ও বিধান প্রেরণের জন্য আল্লাহ তা’য়ালা ওয়াদা করেছেন। (বাকারা ২: ৩৮)।

মহান আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর ওয়াদা মাফিক নবী-রাসূলদের মাধ্যমে যুগে যুগে এই হেদায়েত প্রেরণ করেছেন। সর্বশেষ হেদায়াত আল-কুরআন নাযিল করেছেন শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) এর নিকট। তবে সেই হেদায়াত থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য তাকওয়ার অধিকারী হতে হবে।

‘‘ইহাই সেই কিতাব, এতে কোনোই সন্দেহ নেই। মুত্তাকীদের (তাকওয়াধারীদের) জন্য এটা হেদায়েত।’’ (বাকারা ২:২)।

দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতার জন্য আল-কুরআন থেকে হেদায়াত লাভ করা অপরিহার্য। কিন্তু কোনো অসংযমী, অপরের অধিকার হরণকারী, মিথ্যাচারী বা কপট ব্যক্তি কুরআন থেকে হেদায়াত লাভ করবে না। তাই কুরআনী হেদায়াতের আলোতে জীবনকে সুন্দর করার জন্য তাকওয়া অর্জনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেই সকলে।

৪. সত্য-মিথ্যা ও ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্যকারী জ্ঞান লাভে তাকওয়া

মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন- ‘‘হে মুমিনগণ! যদি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করে চল তবে আল্লাহ তোমাদেরকে ফুরকান দান করবেন।’’ (আনফাল ৮: ২৯)।

-ফুরকান হলো সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, সভ্যতা-অসভ্যতার পার্থক্যকারী জ্ঞান।

-আল-কুরআনের অপর নাম আল-ফুরকান।

-আল-কুরআনে মানবজাতির জন্য আছে ফুরকান। (বাকারা ২: ১৮৫)।

-মানবজীবন দ্বন্দ্বমুখর। (বালাদ ৯০: ৪)। আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক নানা টানাপোড়েনে অবিরাম আক্রান্ত হই আমরা। অধিকার চায় এখানে সবাই। দায়িত্বে আগ্রহী নয় কেউই। কোথায় কতটুকু কার অধিকার, কিভাবেই বা তা আদায় করা যাবে সে জ্ঞান ছাড়া সুষ্ঠু-সুন্দর-ভারসাম্যপূর্ণ জীবন ও সমাজ কল্পনা করা যায় না।

-আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন তাকওয়া অবলম্বন করে চললে সেই জ্ঞান তিনি তার বান্দাদের দান করবেন। তাই ন্যায় ও সত্যভিত্তিক সুসভ্য সমাজ গড়ার জন্য আমাদের জীবনে তাকওয়া অপরিহার্য।

উপসংহার:

১. মানবজাতির প্রতি আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নেয়ামত আল-কুরআন। তাকওয়া ছাড়া আল-কুরআন থেকে হেদায়াত পাওয়া যাবে না।

২. তাকওয়া হচ্ছে কল্যাণময় কাজে নিয়োজিত হওয়া এবং অকল্যাণকর কাজগুলি বর্জন করার আত্মিক গুণ।

৩. তাকওয়া হচ্ছে অন্যায়-অবিচার বর্জন করার আত্মিক শক্তি।

৪. তাকওয়া হচ্ছে সমাজের মানুষের মাঝে সুষ্ঠু ও ভারসাম্যপূর্ণ পারস্পারিক সম্পর্ক গড়ার দিক-নির্দেশনা।

৫. সর্বোপরি তাকওয়া হচ্ছে আখিরাতে জাহান্নাম থেকে নাজাত লাভ ও জান্নাত হাসিলের নিশ্চয়তা।

আসুন, যেনতেনভাবে রোজা পালন না করি। দুনিয়া ও আখিরাতকে সৌন্দর্যমন্ডিত ও আলোকিত করার এই মহান নিয়ামতকে যথাযথভাবে ব্যবহার করে নিজেরা তাকওয়ার অধিকারী হই। নিজেদের সংযমী, সত্যবাদী ও ন্যায়বান মানুষ হিসেবে গড়ে তুলি এবং মুত্তাকী পরিবার, সমাজ ও জাতি গঠনে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাই। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর