আপনি পড়ছেন

রমজান ও আল-কোরআন ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রমজানের প্রতি রাতেই জিবরীল (আ.) রসুল (সা.) এর সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং তারা পরস্পর কুরআনের দারস করতেন।(ইউদা-রিসুহুল কুরআন)। (বোখারী: ৬)

ramadan and al quaran 2রমজান মাসেই নাযিল হয়েছে আল-কুরআন, যা মানুষের হেদায়াত ও মুক্তির দলিল এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী

ফাতিমা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন নবী (সা.) আমাকে একান্তে গোপনে বলেছেন, "প্রতি বছর জিবরীল (আ.) আমার সাথে একবার কুরআন শুনেন এবং শুনান: কিন্তু এ বছর তিনি আমার সাথে দু’বার এ কাজ করেছেন। আমার মনে হচ্ছে আমার মৃত্যু আসন্ন।" (বুখারী ৪৯৯৭)

উল্লেখিত হাদীস দুখানি হতে রমজান মাসে বেশি বেশি কুরআন অধ্যয়ন করা, এজন্য জমায়েত হওয়া, অপেক্ষাকৃত বেশি কুরআন অভিজ্ঞ ব্যক্তির কাছ থেকে কুরআন শিক্ষা করা, শিক্ষনীয় বিষয়সসূহ স্মরণ করা ও স্মরণ করিয়ে দেয়া, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ জেনে নেয়া নবী (সা.) এর আমল দ্বারা প্রমাণিত।

রমজানের রাতে নবী (সা.) ও জিবরীল (আ.) কুরআনের এই ক্লাসে বসতেন। কারণ রাতের বেলা মানুষ অবসর থাকে, পরিবেশ থাকে কোলাহল মুক্ত, মন থাকে উন্মুক্ত-প্রশান্ত-প্রশস্ত। আল্লাহপাক বলেন-

"নিশ্চয়ই রাত্রি জাগরণ মনের একাগ্রতা ও হৃদয়ঙ্গমের জন্য অতিশয় অনুকূল।"(মুজ্জাম্মিল ৭৩: ৬)

প্রথমোক্ত হাদীসে এসেছে নবী (সা.) ও জিবরীল কুরআনের দারস করতেন। অর্থাৎ এর বিষয়বস্তু বুঝা ও হৃদয়ঙ্গম করা, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও প্রয়োগ শিক্ষা করা এবং বাস্তবায়ন পদ্ধতি শিক্ষা করা। অতএব, আজকালকার মতো না বুঝে গড়গড় হরহর করে পাঠ করে কুরআন খতম করতেন না।

বস্তুত: কুরআন মজীদের মধ্যে রয়েছে-

# মানব জাতির জন্য হেদায়াত

# হেদায়াতের দলিল বা প্রমাণ এবং

# ফুরকান বা সত্য-মিথ্যার, ন্যায়-অন্যায়ের জ্ঞান। (বাকারা ২: ১৮৫)

মানবজাতির জন্য কুরআন হেদায়াত:

বহু মানুষের আজ প্রশ্ন- আমি কি করবো? কোনো পথ পাচ্ছি না কোন দিকে যাব? চিন্তা করে দেখুন এ অবস্থা কি আমার-আপনার জীবনে আসেনি?

- শুধু আমাদের জীবনে কেন পূর্ববর্তী আম্বিয়া (আ.) এমনকি নবী (সা.)-এর জীবনেও এসেছে।

- মুসা (আ.) যখন তার জাতিকে নিয়ে লোহিত সাগরের সামনে উপস্থিত, পিছনে ধেয়ে আসছে ফিরাউনের বিশাল বাহিনী- অশ্বারোহী, পদাতিক, কমান্ডো বাহিনী, এলিট ফোর্স ইত্যকার যত রকম বাহিনী আজ আমরা কল্পনা করতে পারি। বনি ইসরাইল আর্তনাদ কর উঠলো:

"আমরা তো ধরা পড়ে গেলাম।"

মুসা (আ.) বললেন:

"কখনই না! আমার সাথে আছেন আমার রব। শীঘ্রই তিনি আমাকে পথনির্দেশ করবেন।" (শুআরা ২৬: ৬১-৬২) এর পরের ঘটনা আমরা সবাই জানি।

-নবী (সা.) এর হিজরতের রাতে একই অবস্থা হল। সাওর গুহায় নবী (সা.) ও আবু বকর (রা.) ২ জন মাত্র। বাইরে আবুজাহেলের হায়েনারা। একটু নজর করলেই দেখে ফেলবে তাদের। আবু বকর (রা.) নবী (সা.)-কে তা-ই বললেন। নবী (সা.) কি বললেন?-

"লা তাহযান, ইন্নাল্লাহা মাআ’না।" "দুচিন্তা করো না, আল্লাহ তো আমাদের সাথে আছেন।"(তাওবা ৯: ৪০)

পরবর্তীতে যা হলো তা আল্লাহর ভাষায় শুনি-

"অতঃপর আল্লাহ তার উপর, তাঁর প্রশান্তি বর্ষণ করেন এবং তাকে শক্তিশালী করেন এমন এক বাহিনী দিয়ে- যা তোমরা দেখনি, এবং তিনি কাফিরদের কথা হেয় করেন। আল্লাহর কথাই সবার উপরে এবং তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।" (তাওবা ৯: ৪০)
-অথবা আসহাবে কাহাফের সেই কয়জন যুবকের কথা যারা তাদের ঈমান রক্ষার জন্য আল্লাহর সাহায্য চাইলো:

"হে আমাদের রব! তুমি নিজ থেকে আমাদের প্রতি রহম করো এবং আমাদের কাজকর্ম সঠিকভাবে পরিচালনার ব্যবস্থা করো।" (কাহ্ফ ১৮: ১০)

আল্লাহপাক এর জবাবে কি বললেন দেখুন-

"তোমরা যখন বিচ্ছিন্ন হলে তাদের থেকে ও তারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ইবাদত করে তাদের থেকে তখন তোমরা গুহায় আশ্রয় গ্রহণ কর। তোমাদের রব তোমাদের জন্য তার দয়া বিস্তার করবেন এবং তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের কাজকর্মকে ফলপ্রসূ করবার ব্যবস্থা করবেন।" (কাহ্ফ ১৮: ১৬)

তিনটি ঘটনা তিনটি জামনা। ২ জন নবী আর একদল আল্লাহওয়ালা যুবকের পেরেসানী ও তাদের দোয়ার জবাবে আল্লাহর ব্যবস্থাপনা। কিন্তু প্রত্যেক ক্ষেত্রেই আমরা দেখি আল্লাহর বান্দারা তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেছেন, অতঃপর আল্লাহর সাহায্য প্রার্থী হয়েছেন।

আল্লাহ তাঁর কুদরতী ব্যবস্থাপনায় তাদের সাহায্য করেছেন, সফলতা দান করেছেন।

১ম ঘটনা: মুসা (আ.) দীর্ঘদিন ফিরআউনকে দাওয়াত দিয়েছেন। তার নানা কুতর্কের জবাব দিয়েছেন। তাকে বিভিন্ন মোজেজা প্রদর্শন করা হয়েছে। তার নিয়োজিত যাদুকরদের মোকাবেলা করেছেন প্রকাশ্য জনসমাবেশে, জাতীয় অনুষ্ঠানে। মুসা (আ.) তার জাতির লোকদের ঐক্যবদ্ধ করেছেন। কারণ একই রাতে বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বনী-ইসরাইলদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য- ব্যাপক সাংগঠনিক প্রস্তুতি দরকার। আবার এমন নয় যে বনী-ইসরাইলীদের সবাই মুসা (আ.) এর সাথে একমত ছিল। আল্লাহ বলেন-

“ফিরআউন ও পরিষদবর্গ নির্যাতন করবে এই আশঙ্কায় মুসার সম্প্রদায়ের একদল ছাড়া আর কেউ তার প্রতি ঈমান আনেনি।"(ইউনুস ১০: ৮৩)

"তারা বলতো, আমাদের কাছে তুমি আসার আগেও আমরা নির্যাতিত হয়েছি। আর তুমি আসার পরও।"(আরাফ ৭: ১২৯)

২য় ঘটনা: নবী (সা.) তার হিজরতের সময় বিস্তারিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কে পথ দেখাবে, বিরোধী শক্তি কি কি পদক্ষেপ নিবে। তার বিপরীতে কি কি কৌশল নেয়া হবে। কোথায় থামবেন, কারা খাদ্য এবং খবর দিয়ে সহায়তা করবে, তা বিস্তারিত সীরাত গ্রন্থগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে। অতঃপর তারা আল্লাহর উপর তায়াককুল করেছেন।

৩য় ঘটনা: আসহাবে কাহাফের ঘটনাও আমরা দেখি রাজ পরিবার ভুক্ত এই যুবকেরা যখন ঈমান রক্ষার্থে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিল, নিজেদের আরাম সুখ ও ক্ষমতার অংশীদারিত্বের সুযোগ পায়ে দলে ঈমান রক্ষার্থে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা হল তখন পরবর্তী করণীয় আল্লাহপাক তাদের অন্তরে জাগিয়ে দিলেন। তারপর এমনভাবে তাদের সফল করলেন যে আজ হাজার হাজার বছর পর তাদের ঈমানদীপ্ত কাহিনী আমরা পাঠ করছি এবং ঈমানের পথে কুরবানীর জন্য উজ্জীবিত হচ্ছি। নবী (সা.) অন্তত সপ্তাহে একবার জুমুআ’বার তাদের বিষয়ে অর্থাৎ সুরা কাহফ কমপক্ষে তার প্রথম ১০ আয়াত পাঠ করতে নসীহত করেছেন। এভাবে চলতে থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত। সুবহানাল্লাহ!

আমরা ইসলামকে অন্য সব ধর্মের মতো একটা আচারসবর্স্ব ধর্ম ধরে নিয়েছি। কুরআনকে মনে করছি সেরকমই একটা মন্ত্রসর্বস্ব ধর্মীয় কিতাবের মতো। এটা যে বুঝে পাঠ করতে হবে, এর কথাগুলো যে বুঝতে হবে, মানতে হবে, নিজেদের দায়িত্বগুলো পালন করতে হবে সে শিক্ষা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এভাবে নবী (সা.) কুরআন পড়েননি। পড়েননি তার সাহাবা (রা.)-ও।

কুরআনের পাঠ-পঠনের মাধ্যমে এর শিক্ষাকে জীবন্ত করে তুলতে হবে। নাহলে নবী (সা.) ও আবু বকর (রা.) কে সওর গুহায় কি কেন কখন বলেছিলেন তাতে আমাদের জন্য কি শিক্ষা আছে তা আমাদের অধরাই থেকে যাবে। আসহাবে কাহাফের ঈমানদীপ্ত কাহিনী তারাবীতে পাঠ হবে কিন্তু তার শিক্ষা ও আমল অজানাই থেকে যাবে।

এভাবে তো হবে না। কুরআনের ধারক-বাহকদের, কুরআনের ওস্তাদ ও শিক্ষকদের কুরআনকে জিন্দা করে তুলতে হবে নিজেদের জীবনে।

আরেকটা কথা। আমরা মুসলমানরা, ইসলামের পথের পথিকরা আজ গোটা বিশ্বে দুর্বল। হাকিয়ে বেড়াচ্ছে আল্লাহর দুশমনরা আমাদের চতুর্দিকে। আমরা হঠকারী কোনো কাজ করতে পারবো না। উগ্রতা ও সন্ত্রাস করে নিরীহ মানুষের ক্ষতি করার অনুমতি আমাদের দেয়নি শরীয়ত। কিন্তু আমাদের আছে এক হাতিয়ার যা অব্যর্থ- ‘‘রাত্রি বেলার তীর’’ (তাহাজ্জুদে আল্লাহর নিকট দোয়া)। এই অব্যর্থ হাতিয়ার প্রয়োগের এটাই আদর্শ সময়:

- রমজান মাস

- আমরা মজলুম

- রাতে কিয়ামুল লাইল (তারাবী/তাহাজ্জুদ)।

এই সবগুলি বিষয়ই দোয়া কবুলের উপযুক্ত পরিবেশ। অতএব হে আল্লাহর বান্দা-বান্দীরা ঘুমে রাত্রি কাটায়েন না। এই অব্যর্থ হাতিয়ারের এস্তেমাল বা ব্যবহার করুন। আল্লাহর সাথে কথা বলুন দিনে রাতে যখনই সময় পান। আল্লাহর কাছে দোয়া করুন তাঁর সুন্দর সুন্দর নামের উসীলায়। আমরা তাঁর দুর্বল মুমিন বান্দা-বান্দী- আমাদের ঈমানের উসীলায়। দোয়া করি আসুন সবাই আমাদের নিজেদের জন্য, সন্তানদের জন্য, জাতির জন্য, ইসলামের পথে অগ্রসৈনিকদের জন্য। দোয়া করি সুস্থতার জন্য যাতে ঈমানের পথে চলতে ও কাজ করতে পারি। দোয়া করি হালাল রিজিকের জন্য যাতে জালেমের সাহায্যপ্রার্থী হতে না হয় ইসলামের পথের পথিকদের। ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে রমজানে রমজানে মসজিদে মসজিদে হাত পাততে না হয় আল্লহর দুশমনদের কাছে। ইনিয়ে-বিনিয়ে নিজেদের খেদমতের দোহাই দিয়ে ভিক্ষা করতে না হয়।

দোয়া করি নিজেদের ঈমানের জন্য, ইলমের জন্য, দ্বীনি আখলাকের জন্য যাতে সন্তুষ্ট থাকতে পারি আল্লাহর কদরে ও তাঁর দেয়া হালাল নেয়ামতে। সুন্দর সুন্দর বাড়ি-ফ্ল্যাট-গাড়ির পিছনে যেন দ্বীনি ব্যক্তিরা না ছুটেন- আর এই যুক্তি দেন ‘‘সবাই তো বড়লোক হতে চায়।’’ “লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্যাহ,” আল্লাহর কি মেহেরবানী এ যামানায় আমাদের জন্ম দিয়েছেন। নইলে রসুল (সা.) আর তার সাহাবারা বা প্রাথমিক যুগের মুসলিমরা এ কথা শুনলে না জানি কি মনে করতেন আমাদের।

দোয়া করি আমাদের জাতির জন্য। জাতির নেতৃবৃন্দ ও দায়িত্বশীলদের জন্য। আল্লাহপাক যেন সবাইকে হায়াতে তৈয়্যেবা দেন, ঈমানের পথে চলবার তাওফীক দেন। কেবল বেশি বেশি নেক কাজ করার হিম্মত ও হিকমত দেন। জাতির কল্যাণ করার জন্য তাদের কবুল করেন এবং তার মধ্য দিয়ে হাশরের কঠিন দিনে তাদের আরশের ছায়ায় আশ্রয় দেন, তাদের ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাত নসীব করেন।

বেশি বেশি নেক আমল করি, কল্যাণকর কাজ করি। সিয়াম, সলাত, সদাকা, কুরআন অধ্যয়ন, দোয়া। আমাদের ঘরগুলো, অবস্থানগুলো বরকতময় করে তুলি কল্যাণকর কাজে। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন। আমীন।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর