আপনি পড়ছেন

কুরআনকে হৃদয়ের বসন্ত বানিয়ে নেই। দুঃখ-দুশ্চিন্তার সময় রসুল (সা.) এ দোয়া পাঠ করতে শিক্ষা দিয়েছেন: “হে আল্লাহ! আমি আপনার বান্দা, আপনারই এক বান্দার সন্তান এবং আপনার এক বান্দীর সন্তান। আমি আপনার নিয়ন্ত্রণে, আমার ব্যাপারে আপনার ফয়সালা চূড়ান্ত। আমার ব্যাপারে আপনার সমস্ত ফয়সালা ন্যায়সংগত। আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি আপনার প্রতিটি নামের উসীলায়- যে নামে আপনি নিজেকে অভিহিত করেছেন, অথবা আপনি আপনার কিতাবে নাযিল করেছেন, বা আপনি আপনার সৃষ্টির কাউকে শিক্ষা দিয়েছেন, অথবা আপনি গায়েবের পর্দায় তা আপনার কাছে অদৃশ্য রেখেছেন। আপনি কুরআনকে বানিয়ে দিন আমার হৃদয়ের বসন্ত, বক্ষের জ্যোতি, আমার দুঃখের অপসারণকারী এবং আমার দুশ্চিন্তা দূরকারী।

ramadan and al quaranরমজান মাসেই নাযিল হয়েছে আল-কুরআন, যা মানুষের হেদায়াত ও মুক্তির দলিল এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী

নবী (সা.) বলতেন, যে কেউ এ দোয়া করবে, তার দুশ্চিন্তা, দুঃখ এবং হতাশা চলে যাবে। সে এসব থেকে মুক্তি পাবে এবং আল্লাহতা’য়ালা এসবকে সুখ-সমৃদ্ধি এবং প্রশান্তি দ্বারা পরিবর্তন করে দিবেন।’’ (মুসনদে আহমদ)

এ এক অভিনব দোয়া। অপূর্ব তার আবেদন। আল্লাহ রব্বুল ইজ্জতের কাছে চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের চেতনায় ভরপুর এক দোয়া।

রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, এ দোয়া অবশ্যই তার পাঠকারীকে সব দুঃখ-দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দান করে তাকে সমৃদ্ধি ও প্রশান্তি দান করবে। কিন্তু দোয়ায় একটা প্রোগ্রাম দেয়া হয়েছে- করআনমুখী হওয়ার প্রোগ্রাম। এ দোয়া পাঠ করলাম কিন্তু কুরআন পাঠ করলাম না, তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করলাম না, তা থেকে হেদায়াতের আলো নিলাম না, জীবন সমস্যার সমাধান নিলাম না- তাহলে কিভাবে তা আমার হৃদয়ের বসন্ত হবে অথবা হবে অন্তরের নূর কিংবা দূর করবে আমার চিন্তা-পেরেসানী!

আসুন আমরা ফিরে যাই আল-কুরআনের বিষয়বস্তুতে। আল্লাহ বলেন, এর মধ্যে আছে-

১. মানবজাতির জন্য হেদায়াত

২. হেদায়াতের দলিল

৩. সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী জ্ঞান- ফুরকান। (বাকারা ২: ১৮৫)

# আল-কুরআন হেদায়াতের দলিল

• আমরা প্রায়ই এ কথা শুনি সমাজে যে, এত রকম মত-পথ আমরা কোনদিকে যাব? একেক শায়খ একেক কথা বলছেন, একেক দল একেক দিকে ডাকছে- আমরা কোনদিকে যাব?

• এই প্রশ্নের জবাব হল- আমরা সবাই কুরআনে দেখানো পথেই যাব। যে বা যারা কুরআন-ভিত্তিক আহ্বান জানাবে তার দাওয়াতে আমরা সাড়া দিব। কুরআন-ভিত্তিক বলতে আবার কেউ হাদীস বাদ দিয়ে কুরআন বুঝার কথা যেন না বুঝি। হাদীস বাদ দিয়ে কুরআন বুঝা যায় না। কুরআন অনুযায়ী আমলা করা, জীবনযাপন করা যায় না:

> আল্লাহ পাক বলেন, “রসুল এই উদ্দেশ্যেই প্রেরণ করেছি যে, আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে তার আনুগত্য করা হবে।” (নিসা ৪: ৬৪)

> তিনি আরো বলেন, “কিন্তু না, তোমার রবের কসম! এই লোকেরা কখনোই ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না তাদের নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদ ও মতপার্থক্যের বিচার ভার তোমার ওপর অর্পণ না করে; অতঃপর তোমার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তাদের মনে কোনো দ্বিধা না থাকে এবং সম্পূর্ণভাবে ও সন্তুষ্টি সহকারে তা মেনে না নেয়।” (নিসা ৪: ৬৫)

এ প্রসঙ্গে আরো একখানি আয়াত হতে আমরা দিক-নির্দেশনা পাই:

> “রসুল তোমাকে যা দেয় তা তোমরা গ্রহণ করো এবং যা থেকে তোমাদের নিষেধ করে তা থেকে বিরত থাক।” (হাশর ৫৯: ৭)

তাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা বলেন,

> “কেউ রসুলের আনুগত্য করলে সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করলো এবং কেউ মুখ ফিরিয়ে নিলে তোমাকে তাদের ওপর তত্ত্বাবধায়ক প্রেরণ করিনি।” (নিসা ৪: ৮০)

• অতএব, আমাদের সবাইকে আল-কুরআন ও সহীহ হাদীসের শিক্ষা অনুযায়ীই চলতে হবে। তাহলেই আমরা সঠিক পথ পাব। কিন্তু বুঝবো কিভাবে- কেউ আমাদের কুরআন-হাদীস অনুযায়ী ডাকছে বা শিক্ষা দিচ্ছে, না মনগড়া কোনো পথে আহ্বান জানাচ্ছে। সেই জন্য কুরআন বুঝে বুঝে সাধ্যমত তফসীর সহকারে পাঠের কোনো বিকল্প নেই। সবারই সাধ্যমত কুরআন বুঝে বুঝে পাঠ করা দরকার।

• সব ব্যাপারেই আমরা বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেই। কুরআনের ব্যাপারেও বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। কুরআন জানেন ও মানেন হকপন্থী, সুবিধাবাদী নন, সম্পদ-লোভী নন এমন শায়খ ও ওস্তাদ সমাজে ভুরিভুরি আছে এমন কথা বলতে পারবো না। তবে তারা বিরলও নন। কিন্তু নিজে কিছুই না জানলে প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। 

• মুফতী শফী (রহ.) তার বিখ্যাত তফসীর মা’রেফুল কুরআনে এ বিষয়ে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা করেছেন। সুরা নিসায় আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-

“তবে কি তারা এই কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে না?” (নিসা ৪: ৮২)

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন,

“…..এ আয়াতের দ্বারা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, প্রতিটি মানুষ কুরআনের উপর গভীর চিন্তা-ভাবনা করুক, এটিই হলো কুরআনের চাহিদা। কাজেই কুরআন সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা কিংবা তার পর্যালোচনা করা শুধুমাত্র ইমাম-মুজতাহিদদেরই একক দায়িত্ব এমন মনে করা যথার্থ নয়। জ্ঞান-বুদ্ধির পর্যায়ের মতই অবশ্য চিন্তা-গবেষণা এবং পর্যালোচনারও বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে। ইমাম-মুজতাহিদদের গবেষণা-পর্যালোচনা একটি আয়াত থেকে বহু বিষয় উদ্ভাবন করবে। ওলামা সম্প্রদায়ের চিন্তা-ভাবনা এসব বিষয় উপলব্ধি করবে। আর সাধারণ মানুষ যখন নিজের ভাষায় কুরআনের তরজমা অনুবাদ পড়ে তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে তখন তাতে তাদের মনে সৃষ্টি হবে আল্লাহ তা’য়ালার মহত্বের ধারণা ও ভালবাসা। এটাই হলো কৃতকার্য হওয়ার মূল চাবিকাঠি। অবশ্য জনসাধারণের জন্য ভুল বুঝাবুঝি ও বিভ্রান্তি থেকে অব্যাহতি লাভ করার জন্য পর্যায়ক্রমিকভাবে কোনো বিজ্ঞ আলিমের কাছ থেকে কুরআন পাঠ করা উত্তম। আর তা সম্ভব না হলে কোনো নির্ভরযোগ্য তফসীর অধ্যয়ন করবে এবং কোনো জটিলতা বা সন্দেহ-সংশয় দেখা দিলে নিজের মনমতো তার কোনো সমাধান করবে না, বরং বিজ্ঞ কোনো আলিমের সাহায্য নিবে।”

(অতঃপর তিনি বিষয়টি আরো বিস্তৃত ব্যাখ্যা করেন) তফসীরে মা’রেফুল কোরআন, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৭২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ প্রকাশিত)

- আমরা বলছিলাম কুরআন হেদায়াতের দলিল। সমাজে বিরাজমান বিভিন্নমুখী চিন্তা হতে সঠিক পথের দিশা লাভ করার জন্য আল-কুরআন সম্পর্কে মোটামোটি ধারণা থাকা জরুরী। বিশেষত: বর্তমান সময়ে যখন নানা বিভ্রান্ত চিন্তা-ভাবনা মুসলিম সমাজকে এলোমেলো করে দিয়েছে।

- আল-কুরআনে আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর নিজের পরিচয় দান করেছেন; দান করেছেন রসুল (সা.) এর পরিচয়, তার দায়িত্ব, দায়িত্ব পালনে তিনি কি পদ্ধতি অবলম্বন করবেন; ব্যাখ্যা করেছেন মানুষের পরিচয়, তার দায়িত্ব-কর্তব্য, ঈমানের বিষয়গুলি, ব্যক্তি পরিবার, অর্থনীতি, রাষ্ট্র পরিচালনা, আইনবিধান, আন্তর্জাতিক নীতি, সন্ধি-চুক্তি, আন্তধর্মীয় সম্পর্কের নীতিমালা, অমুসলিমদের অধিকার ইত্যাদি মানবজীবনের যাবতীয় বিষয়ের প্রয়োজনীয় মূলনীতি। আর এ বিষয়ে ব্যাখ্যা ও বাস্তবায়ন প্রণালী পাই আমরা নবী (সা.) এর সুন্নাহ হতে। 

- দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ ব্যাপারে মুসলিম সমাজের বৃহৎ অংশই অন্ধকারে রয়েছে। তাই জীবন সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা এদিক-ওদিক হাতড়ে বেড়াচ্ছি। ফলে সমস্যা কমছে না, বেড়েই চলেছে। তদুপরি মানবাত্মার সাথে সম্পর্ক বিবর্জিত এই সব মতবাদ ও চিন্তাধারা মানুষের মধ্যে তৈরি করছে শূন্যতা ও দূরত্ব। বাড়ছে হতাশা, জন্ম নিচ্ছে মানবিক মূল্যবোধ শূন্য নতুন প্রজন্মের। মানুষের দুর্গতি ও বিপর্যয় নিয়ে অবৈধ ব্যবসা করতেও তাদের বিবেকে সামান্য বাধে না। অসহায় মানুষের আর্তনাদ তাদের মধ্যে কোনো সহানুভূতি বা মমতা তৈরি করে না। তাতে তারা ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়ানোর নতুন উপায় দেখতে পায় বা কমসেকম মিডিয়ার রেটিং বাড়ানোর উপায় খুঁজে পায়।

- এ অবস্থা থেকে বের হতে হবে আমাদের। তাই কুরআনকে আকড়ে ধরি। বুঝে বুঝে পড়ি। পড়তে গিয়ে মনে বাধা এলে, ছেদ পড়লে হতাশ না হই। পুনরায় শুরু করি। অল্প অল্প করে করে লেগে থাকি। জীবন সমস্যার সমাধান খুঁজি। সমাধানগুলি বাস্তবায়নে লেগে যাই। ব্যর্থতা প্রচেষ্টারই অংশ। প্রথম প্রথম অসুবিধা হবেই। আপত্তি আসবে নিজের আচার-অভ্যাস এমনকি বন্ধু-স্বজন থেকেও। আবারও বলি, হতাশ হওয়া যাবে না। আল্লাহর কাছে দু’হাত তুলে তাওফীক চাই। কুরআনকে হৃদয়ের বসন্ত বানিয়ে নেই। নবী (সা.) এর কথা তো আর ভুল হওয়ার নয়- কুরআনই অন্তরের নূর; দুঃখ-কষ্টের অপসারণকারী, দুশ্চিন্তা দূরকারী।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর