আপনি পড়ছেন

“হে ঈমানদারগণ! যদি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর (অর্থাৎ আল্লাহকে ভয় করে চল) তবে আল্লাহ তোমাদেরকে ন্যায়-অন্যায় পার্থক্য করার শক্তি দিবেন।” (সুরা আনফাল ৮: ২৯)

ramadan and al quranইহা সেই কিতাব (আল-কুরআন) যাতে কোনো সন্দেহ নেই, সুরা বাকারা

# আল-কুরআনের বিষয়বস্তুসমূহের অন্যতম হল ফুরকান। (সুরা বাকারা ২: ১৮৫)

# আল-কুরআনের অপর নাম ফুরকান। (সুরা ফুরকান ২৫: ১)

# পূর্ববর্তী নবীগণকেও (আ.) ফুরকান দান করা হয়েছিল। (সুরা আলে ইমরান ৩: ৩-৪)

ফুরকান শব্দের অর্থ ‘মানদণ্ড’- যা ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, সভ্য-অসভ্যতা প্রভৃতি বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য করে দেয়।

জীবনে চলার পথে প্রতি মুহূর্তে আমাদের সামনে প্রত্যেক বিষয়ে দু’টি পথ ও পদ্ধতি উপস্থিত হয়। একটি সত্যের পথ, কল্যাণের পথ, ন্যায়ের পথ। আবার একই সাথে আসে এর বিপরীতভাবে কাজটি করারও সুযোগ ও সম্ভাবনা। অনেক সময়ই আমরা উপলব্ধি করি- কোনটা সত্য-সঠিক পথ, কোনটা করা উচিত আর কোনটা উচিত নয়। আবার অনেক সময়ই জ্ঞানের ঘাটতি, পরিস্থিতির চাপ-প্রবৃত্তির খায়েশাত, আবার কখনো কখনো সময়ের প্রবণতা (trend) অনুসরণে ঝুঁকিহীনতার (riskfree) আশা আমাদের চিন্তাশক্তিকে আচ্ছন্ন করে দেয়। উচিত অনুচিত বোধ দুর্বল হয়ে যায়।

# একজন ব্যক্তির উচিত-অনুচিত বোধ যখন দুর্বল হয়ে যায় তখন এর বিপদ কিছুটা সীমার মধ্যে থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু একটা জাতি বা একটা সময়ের অধিকাংশ মানবগোষ্ঠীর বিবেক ও নৈতিকতা যখন বিকৃত হয়ে যায় তখন আমরা দেখি হিটলারের উত্থান, হিরোশিমা-নাগাশাকিতে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ, আফগানিস্তান-ইরান-সিরিয়া-লিবিয়ায় গণহত্যা, বসনিয়ায় গণহত্যা, প্যালেস্টাইন-কাশ্মির-রোহিঙ্গা গণহত্যার মত ঘটনাগুলি। বিগত শতাব্দির শুরু থেকে অদ্যাবধি মানবতা ও মানবাধিকারের ধ্বজাধারীরা বিশ্বব্যাপী যে পরিমাণ মানবহত্যা করেছে তা চেঙ্গিস-হালাকু-শক ও হুনদেরও ছাড়িয়ে গেছে বহু আগেই। অপরের সম্পদ, দেশ, তেল এমনকি পানির উপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যুদ্ধের নামে মানুষ হত্যা তো হয়েছেই, এমনকি শিশুখাদ্য ও জরুরী চিকিৎসা সামগ্রীর উপর অবরোধ করে এবং ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম বা মাইন ছড়িয়ে দিয়ে কোনো একটা জাতির ভবিষ্যত বংশধরদের হত্যা ও বিকলাঙ্গ করার নির্মম ও পশু প্রবৃত্তির পরিচয় পাচ্ছি আমরা। নইলে শিশুদের খেলনার আকৃতি দিয়ে কেন মাইন ছড়িয়ে রাখা হচ্ছে সিভিলিয়ান এলাকায়। খাদ্য সামগ্রী ও ব্যবসার উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য আটলান্টিকে ভাসিয়ে দেয়া বা উদ্বৃত্ত পশু মেরে মাটি চাপা দিয়ে দেয়া হচ্ছে।

# সর্বশেষ করোনা পরিস্থিতির জন্য মানুষের সীমাহীন লোভ ও ক্ষমতাবিস্তারই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দায়ী বলে প্রতীয়মান হয়।

# এসব ঘটনার নায়করা এর প্রতিটি ঘটনার পিছনে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী “যৌক্তিক কারণ”-(?!) দেখাবেন। কিন্তু বাস্তব কথা হল এ সবের ফলশ্রুতিতে মানবজাতির চারিদিকে আজ হাহাকার। এর থেকে মুক্তি চাই সবাই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য সে পথ আজকের বুদ্ধিজীবী বা চিন্তকদের জানা নেই।

# আমরা মানুষ। আমাদের মধ্যকার এই দুর্বলতাগুলি সবচেয়ে ভালভাবে জানেন আমাদের স্রষ্টা মহান আল্লাহতা’লা। এ ধরনের পরিস্থিতিতে যেন আমরা না পড়ি বা পড়লেও যেন তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারি তার জন্য তিনিই আমদের কয়েকটি ব্যবস্থা দান করেছেন—

১. তিনি আমাদের সমস্ত বিষয়ের সামগ্রিক জ্ঞানসম্পন্ন জীবনবিধান আল-কুরআন আল-কুরআন দান করেছেন। যা নিজেই ফুরকান বা সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় ও ভাল-মন্দের জ্ঞানের আধার হিসেবে মানবজাতিকে পথ দেখাবে।

২. এই কল্যাণময় ব্যবস্থার দিকে মানবজাতিকে ডাকা এবং সে পথে চলার জন্য, তাদের প্রশিক্ষিত করার জন্য প্রেরণ করেছেন সত্যবাদী এক মহাপুরুষ শেষ নবী (সা.)-কে:

“যারা অনুসরণ করে বার্তাবাহক উম্মী নবীর, যার উল্লেখ তাওরাত ও ঈঞ্জীল যা তাদের নিকট আছে তাতে তারা লিপিবদ্ধ পায়; যে তাদেরকে সৎকাজের নির্দেশ দেয় ও অসৎ কাজে বাধা দেয়, যে তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করে ও অপবিত্র বস্তু হারাম করে এবং যে মুক্ত করে তাদেরকে তাদের গুরুভার ও শৃঙ্খল হতে যা তাদের উপর চেপে ছিল। সুতরাং যারা তার প্রতি ঈমান আনে, তাকে সম্মান করে, তাকে সাহায্য করে এবং যে নূর (তথা আল-কুরআন) তার সাথে নাযিল হয়েছে তাকে অনুসরণ করে তারাই সফলকাম।” (সুরা আরাফ ৭: ১৫৭)

• ‘‘আয়াতে উল্লেখিত গুরুভার ও শৃঙ্খল’’ হল মানবজাতির মনগড়া বিধিবিধান, আচার-ঐতিহ্য, রসম-রীতি ইত্যাদি। যা হেদায়াত বিমুখ ও হেদায়াত বঞ্চিত মানুষেরা ভাল মনে করে নিজেদের জন্য নির্ধারণ করে নিয়েছে, কিন্তু পরিণামে তা তাদের জন্য ভয়াবহ রূপে আবির্ভূত হয়। কিন্তু সত্য সঠিক জ্ঞান না থাকায় তার আবর্ত ও চক্কর থেকে তারা বের হতে পারে না।

• আল্লাহ রসুলকে পাঠিয়েছেন ‘‘রহমাতুল্লিল আলামীন” অর্থাৎ গোটা মানবজাতির প্রতি রহমত হিসেবে। যিনি মানবজাতির হেদায়াতের জন্য শ্রেষ্ঠ পথ প্রদর্শক বা বাতিঘর (lighthouse) হিসেবে কাজ করবেন।

৩. এ কল্যাণকার জীবনবিধান এবং এর শিক্ষক রসুল (সা.)-কে যথাযথভাবে অনুসরণ করার জন্য আল্লাহতা’লা মানব প্রকৃতিতে জন্মসূত্রেই সুপ্ত করে রেখেছেন “তাকওয়া” নামক গুণকে।

তাকওয়ার এই গুণকে যে তার মৌলিক স্বভাব বৈশিষ্ট্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে সে-ই দুনিয়া ও আখিরাতে সফল হবে। আর যে প্রবৃত্তি চরিতার্থ করাকেই নিজ জীবনের নীতি হিসেবে গ্রহণ করবে সে-ই ধ্বংস ও বরবাদ হবে— এই দুনিয়া এবং আখিরাত উভয় স্থানে। (সুরা শামস ৯১: ৭-১০) প্রবৃত্তি পূজারী মানবগোষ্ঠী কিভাবে নিজেরা ধ্বংস হচ্ছে এবং গোটা মানবজাতিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তা আজ আমাদের চর্তুদিকে পরিষ্কারভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি।

• প্রবৃত্তির প্রবল চাহিদার মুখে তাকওয়া তথা আল্লাহভীতি ও আল্লাহ সচেতন মানসিকতাকে জোরদার করার জন্য আল্লাহতা’লা ইবাদাতের অনুষ্ঠানগুলি (যেমন-নামায, যাকাত, সিয়াম ও হজ্জ) দান করেছেন।

এই প্রতিটি ইবাদত সচেতনভাবে এবং যথাযথভাবে আদায় করলে তাকওয়া অর্জিত ও জোরদার হবে। (সুরা বাকারা২: ২১)

• রমজানের রোজার এই দীর্ঘমেয়াদী ইবাদাত মানুষের মধ্যে তাকওয়া-ভিত্তিক জীবনযাপনের চেতনা ও অভ্যাস গড়ে তুলে।

• তাকওয়া মানুষের মধ্যে যত জোরদার হবে ততই মানুষের মধ্যে ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, হক-বাতিলের পার্থক্য করার যোগ্যতা তথা ফুরকানের গুণ বৃদ্ধি পাবে। এটিই আল্লাহতা’য়ালার বাণীর সেই হিকমত ও উদ্দেশ্য:

“হে ঈমানদার মানুষেরা, তোমরা যদি তাকওয়া-ভিত্তিক জীবনযাপন করো তাহলে আল্লাহ তোমাদের মধ্যে ফুরকান দান করবেন।” (সুরা আনফাল ৮: ২৯)

• সুন্দর জীবনের জন্য, কল্যাণময় জীবনের জন্য ফরকান তথা ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ, সত্য-মিথ্যা ও সভ্যতা-অসভ্যতার বুঝ ও জ্ঞান অপরিহার্য। তাই সবাই সঠিকভাবে রোজা রাখি। তাকওয়া অর্জনে সচেষ্ট হই। আল্লাহর বিধান ফুরকান তথা আল-কুরআনের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলি। সত্যপ্রিয় হই, মিথ্যাকে নফরত তথা ঘৃণা করি। অসত্য-অন্যায়কে প্রত্যাখ্যান করি, কারণ তা আমাদের দুনিয়া ও আখিরাতকে বরবাদ করছে—

রসুল (সা.) বলেন, সত্যবাদিতা তো নেকী আর নেকী জান্নাতের পথ প্রদর্শন করে। কোনো বান্দা সত্যের সাধনা করলে (অর্থাৎ সত্য ও হকের পথে দৃঢ়তা অবলম্বন করলে) অবশেষে সত্যবাদী হিসেবে তার নাম লিপিবদ্ধ করা হয়। আর মিথ্যা তো পাপ এবং পাপ জাহান্নামের পথে পরিচালিত করে। আর কোনো বান্দা মিথ্যায় লেগে থাকলে অবশেষে তার নাম মিথ্যাবাদী হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়। (মুসলিম ৬৪০০)

# দেখতে দেখতে এগারোটি রোজা চলে গেল। অনেকেই এখনো গাফিলতির মধ্যে পড়ে আছি। রোজা চলে যাচ্ছে। ক্ষমার মৌসুম চলে যাচ্ছে। নেকী কামানোর মৌসুম চলে যাচ্ছে। লাইলাতুল কদর সামনেই। হঠাৎ করে নিজেকে কেউই বদলে ফেলতে পারবো না। ভাল কাজ করার জন্যও অভ্যাস লাগে। আজ থেকেই শিথিলতা ঝেড়ে ফেলি। ঘুমের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করি। কুরআন অধ্যয়ন বাড়াই। নামাযগুলি বুঝে বুঝে আদায় করি। তারাবীর কেরাআত, রুক-সিজদাগুলি একটু একটু করে দীর্ঘ করি। দোয়া-ইস্তেগফার বাড়াই। গুনাহর কথা স্মরণ করি। সিজদার স্থানগুলো যেন চোখের পানিতে ভিজে যায়। এটাই হতে পারে আমার শেষ রমজান বা শেষ রোজা। কত মানুষের জন্য ইতোমধ্যে তা-ই হয়েছে, তাই না। আমিও তাদের মধ্যে শামিল হতে পারতাম। কালকেই হয়তো তাদের কাতারে যোগ দিতে পারি। কবরের কথা চিন্তা করি। অনন্ত জীবনের কথা চিন্তা করি। সেখানে সুখী হতে চাইলে ‘হে আমার নাফস’ এবং হে আমার ভাই ও বোনেরা আর সময় নষ্ট না করি। সময় ফুরিয়ে যায়, সময় ফুরিয়ে যায়, সময় ফুরিয়ে যায়।

আল্লাহ আমাকে ও আমার ভাই-বোনদের আপনি কবুল করুন। তাওফীক দিন। ইমাম শাফেয়ীর অনুসরণে বলতে চাই- হে আল্লাহ, আমরা আপনার কাছে এ মানবজীবন চাইনি। কিন্তু আপনি মেহেরবানী করে তা দিয়ে আমাদের সম্মানিত করেছেন, ধন্য করেছেন। আমরা আপনার কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছি- আমাদের মাফ করে দিন। আপনার রহমত পাওয়ার মত কাজ করার তাওফীক দিন। আমাদের আপনার জান্নাত দান করুন। ইয়া রব্বুল আ’লামীন।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর